ক্লাসে বসে একমনে পড়া শুনছিল কিশোরী। এমন সময়ই নোবেল কমিটির ঘোষণা— ভারতের কৈলাস সত্যার্থীর সঙ্গে শান্তি পুরস্কার পাচ্ছে সতেরো বছরের পাক কিশোরী মালালা ইউসুফজাই। হাওয়ার বেগে খবর ছড়াল বার্মিংহামে মালালার স্কুলে। আনন্দে মেতে উঠল পড়ুয়ারা। কিন্তু যাকে ঘিরে এত উচ্ছ্বাস, সে তো ক্লাসরুমে। খেয়াল হতেই ক্লাস থেকে মালালাকে টেনে বের করল সহপাঠীরা। শোনাল নোবেল-জয়ের খবর, রেকর্ডের কথা। বিশ্বে এখন মালালাই কনিষ্ঠতম নোবেলজয়ী। শুনে কিশোরীর ঠোঁটে প্রত্যয়ী হাসি, আনন্দে ভাসছে সহপাঠীরা।
মালালা পরে সাংবাদিক বৈঠকে বলেছে, খবরটা প্রথমে বিশ্বাস হয়নি। এখনও মনে হয় আমি নোবেলের যোগ্য নই। তবু সকলকে ধন্যবাদ। বিষয়টা অবশ্য অবিশ্বাস্য লাগছে না তার বন্ধুদের। তাদের কারও কারও মতে, গত বারই তো এমনটা হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু হয়নি। সে দুঃখ এ বার ভুলিয়ে দিল নোবেল কমিটি। নরওয়ের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী তথা নোবেল কমিটির চেয়ারম্যান থরবিয়র্ন ইয়াগল্যান্ডের মতে, মালালার বয়স কম। তা সত্ত্বেও ও নারীশিক্ষা নিয়ে লাগাতার কাজ করে চলেছে। মালালা বুঝিয়েছে ছোটরাও নিজেদের জীবন বদলাতে পারে। এবং মনে রাখা দরকার, প্রাণের ঝুঁকি থাকা সত্ত্বেও ও সব কিছু করেছে।সেই সাহসকে কুর্নিশ জানাতেই নোবেল। বাস্তবিক। তালিবানি নিয়মে চলা পাকিস্তানের সোয়াট উপত্যকায় নারীশিক্ষা নিয়ে প্রচার শুরু করার পরই কিশোরী বুঝে গিয়েছিল, তার প্রাণসংশয় রয়েছে। তবু দমেনি। তার পর এক দিন স্কুল থেকে ফেরার পথে তার উপর প্রাণঘাতী হামলা চালাল তালিবান। তখনও হাল ছাড়েনি সে। হয়তো সেই জেদের কাছেই হার মেনেছিল মৃত্যু। লন্ডনে নতুন জীবন শুরু করেছিল মালালা। কিন্তু সে তো দুবছর আগের কথা। তার পর কেন নিজের দেশে ফিরতে পারেনি সোয়াটের এই কিশোরী? যদি সত্যি তার কাজ দুনিয়াকে ব্যাপক ভাবে প্রভাবিত করে থাকে, যদি মালালা সত্যিই বিশ্বের অন্যতম জনপ্রিয় ;সেলিব্রিটি হয়ে থাকে, তা হলে কেন তাকে ফেরানোর কথা ভাবছে না পাকিস্তান? স্বয়ং পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফ এ দিন বলেছেন, ওর জন্য গোটা দেশ গর্বিত। তা হলে? কারণ একটাই। সোয়াটের ছবিটা আজও কম-বেশি একই রকম। মালালার উপর হামলা চলার পর হয়তো সামান্য নড়েচড়ে বসেছিল প্রশাসন। ব্যস্, ওটুকুই। আজও তালিবানি রক্তচক্ষু উপেক্ষা করতে পারে না সোয়াট। এতেই শেষ নয়। কোনও কোনও বাসিন্দার চোখে, মালালা পশ্চিমী দুনিয়ার সৃষ্টি। তাকে ব্যবহার করে পাকিস্তানের কৃষ্টি-ঐতিহ্য নষ্ট করে চায় পশ্চিমের দেশগুলো। গত বার নোবেলের জন্য মনোনয়ন পাওয়ার পর কেউ বা কারা সোশ্যাল মিডিয়ায় লিখেছিল, আমরা মালালা ইউসুফজাইকে ঘৃণা করি। ও আদতে সিআইএ-র এজেন্ট। তা বাদে প্রাণে মারার হুমকি তো ছিলই। আজও রয়েছে। মালালা যদিও বিশ্বাস করে,পাকিস্তান শান্তি চায়। হানাহানিতে তার মোটেও সায় নেই।তার মুখে শান্তির কথা অবশ্য এই প্রথম নয়। গত বছর নিজের জন্মদিনে রাষ্ট্রপুঞ্জে দেওয়া বক্তৃতাতেও শান্তির বার্তা দিয়েছিল কিশোরী। বুঝিয়েছিল শিক্ষার মাহাত্ম্য। তার বয়ানে, চরমপন্থীরা বই ও কলমের শক্তিকে ডরায়। আর সেই কারণেই সকলের জন্য শিক্ষার ব্যবস্থা হওয়া উচিত। মালালা চায় তালিবান এবং তাদের ছেলে-মেয়েরাও যেন সেই শিক্ষার অধিকার থেকে বঞ্চিত না হয়। তবেই এগোবে সমাজ, আসবে শান্তি।
শুধু রাষ্ট্রপুঞ্জে বক্তৃতা দিয়েই অবশ্য থেমে যায়নি কিশোরী। মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার সঙ্গে নিজের লক্ষ্য নিয়ে আলোচনা করেছে। নাইজেরিয়ায় বোকো হারাম জঙ্গিদের হাতে অপহৃত দুশোর বেশি ছাত্রীর মুক্তির জন্য সে দেশের প্রেসিডেন্টের সঙ্গেও কথা বলেছে। গত দুবছরে আরও এমন বহু কাজে অংশ নিয়েছে মালালা। লেখাপড়ার পাশাপাশিই চলেছে সব।
বাবা জিয়াউদ্দিন ইউসুফজাইকে এ দিন বিশেষ ভাবে ধন্যবাদ জানিয়েছে মালালা। আমাকে আমার মতো করে বাঁচতে দেওয়ার জন্য বাবার কাছে আমি কৃতজ্ঞ। একই সঙ্গে শিক্ষিকা ও সহপাঠীদের ধন্যবাদ জানিয়েছে। আনন্দের মাঝেই নিজ লক্ষ্যে অবিচল সে বলেছে,এই জয় নারী শিক্ষা প্রচারের লক্ষ্যে ব্যাপক সাহায্য করবে। এর পর আমার বার্তা আরও বহু শিশুর কাছে পৌঁছে দিতে পারব। তার এই সাফল্যে খুশি পাকিস্তানে বসবাসকারী আত্মীয়-পরিজনেরা। ফোনে মালালাকে অভিনন্দনও জানিয়েছেন তাঁরা।
মেয়ের নোবেল জয়ের জন্য কতটা উৎসব করল পরিবার? স্পষ্ট জানা যায়নি। আসলে জনসমক্ষে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করতে গেলেও তো মালালার পরিবারকে তাড়া করে ফিরবে তালিবানের ভয়। দ্বিধা, ভয়, আশঙ্কা থেকে আজও মুক্ত নয় তার জন্মভূমি। আর তাই বোধহয় নোবেল জিতেও পুরোপুরি সন্তুষ্ট নয় সোয়াটের সাহসিনী।
বদলটা যে সেখানেও আনা দরকার।