পবিত্র হজ নিয়ে আপত্তিকর মন্তব্য এবং প্রধানমন্ত্রীর পুত্র সম্পর্কে কটূক্তি করার প্রায় দুই সপ্তাহ পর মন্ত্রিত্ব ও দলীয় পদ হারালেন আবদুল লতিফ সিদ্দিকী। বিতর্কের মুখে তিনি পদত্যাগ না করায় সংবিধান অনুযায়ী মন্ত্রী হিসেবে তাঁর ‘নিয়োগ অবসান’ ঘটানো হয়েছে।
গতকাল রোববার দুপুরে মন্ত্রিসভা থেকে অব্যাহতি দেওয়ার পর রাতেই দল থেকেও বাদ দেওয়া হয় আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী এই মন্ত্রীকে। আওয়ামী লীগের কার্যনির্বাহী কমিটির বৈঠকের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, তাঁকে দলের নীতিনির্ধারণী সর্বোচ্চ ফোরাম প্রেসিডিয়াম থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়। একই সঙ্গে দলের প্রাথমিক সদস্যপদ সাময়িক স্থগিত করা হয়েছে। কেন তাঁকে চূড়ান্তভাবে বহিষ্কার করা হবে না, তা জানতে গঠনতন্ত্র মোতাবেক সাত দিনের মধ্যে কারণ দর্শাতে বলা হয়েছে।
এসব সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময় লতিফ সিদ্দিকী দেশের বাইরে ছিলেন। গতকাল রাত আটটায় তাঁর সঙ্গে ফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি কলকাতায় আছেন বলে জানান। লন্ডন থেকে গতকালই তিনি কলকাতা ফিরেছেন। শিগগির তিনি দেশে ফিরতে চান বলে পারিবারিক সূত্র জানিয়েছে।
সংবিধানের ৫৮(২) ধারা অনুযায়ী, প্রধানমন্ত্রী যেকোনো সময়ে কোনো মন্ত্রীকে পদত্যাগ করতে অনুরোধ করতে পারেন এবং ওই মন্ত্রী অনুরোধ পালনে অসমর্থ হলে তিনি রাষ্ট্রপতিকে ওই মন্ত্রীর নিয়োগের অবসান ঘটানোর পরামর্শ দিতে পারেন।
সংবিধানের এই ধারা উল্লেখ করে মন্ত্রিপরিষদ সচিব মোহাম্মদ মোশাররাফ হোসাইন ভূইঞা বলেন, প্রধানমন্ত্রী সংবিধান অনুযায়ী লতিফ সিদ্দিকীর মন্ত্রী পদের নিয়োগের অবসান ঘটানোর জন্য রাষ্ট্রপতিকে পরামর্শ দেন। প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ অনুযায়ী রাষ্ট্রপতি সংবিধানের ৫৮ অনুচ্ছেদের(১) দফার (গ) উপদফা অনুসারে তাঁকে মন্ত্রী পদের নিয়োগের অবসান ঘটানোর নির্দেশ প্রদান করেন।
কিন্তু নিয়োগের অবসান ঘটানো হলেও তাঁকে পদত্যাগ করতে বলা হয়েছিল কি না, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে মন্ত্রিপরিষদ সচিব বলেন, প্রথম শর্ত কাজ করেনি বলেই দ্বিতীয় শর্ত প্রয়োগ করা হয়েছে।
তবে এ বিষয়ে সরকারের বেশ কয়েকজন নেতা ও মন্ত্রীর সঙ্গে যোগাযোগ করে সুস্পষ্ট ধারণা মেলেনি। প্রধানমন্ত্রীর পক্ষ থেকে কে এবং কবে তাঁকে পদত্যাগ করতে বলেছেন, তা জানা যায়নি।
দেশের ইতিহাসে কোনো মন্ত্রীকে এভাবে অপসারণের এটি দ্বিতীয় ঘটনা। ১৯৮০ সালে রাষ্ট্রপতিশাসিত শাসনব্যবস্থায় মওদুদ আহমদের মন্ত্রিত্বের অবসান ঘটিয়েছিলেন প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান। মওদুদের লেখা চলমান ইতিহাস বইয়ে এর উল্লেখ রয়েছে। সংসদীয় সরকারব্যবস্থায় দেশে এর আগে কোনো মন্ত্রীকে অপসারণ করা হয়নি।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গতকাল দুপুরে বঙ্গভবনে রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদের সঙ্গে দেখা করেন। মন্ত্রিপরিষদ সচিব আগে থেকেই সেখানে অবস্থান করছিলেন। রাষ্ট্রপতির প্রেস সচিব ইহসানুল করিম প্রথম আলোকে জানান, প্রধানমন্ত্রী নিউইয়র্ক থেকে ফিরেছেন, রাষ্ট্রপতি ফিরেছেন হজ পালন করে। তাই এটা ছিল সৌজন্য সাক্ষাৎ। তবে সেখানে অন্যান্য বিষয় নিয়েও আলোচনা হয়েছে।
বঙ্গভবন সূত্র জানায়, সৌজন্য সাক্ষাৎ বলা হলেও তখনই চূড়ান্ত হয় লতিফ সিদ্দিকীর মন্ত্রিত্বের অবসান ঘটানোর বিষয়টি। ওই সাক্ষাতের পরপরই বঙ্গভবন থেকে সচিবালয়ে ফিরে মন্ত্রিপরিষদ সচিব সংবাদ ব্রিফিং করে তাঁর মন্ত্রিত্ব অবসানের সিদ্ধান্তের কথা আনুষ্ঠানিকভাবে জানান। এরপর এ-সংক্রান্ত প্রজ্ঞাপন জারি করে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ।
লতিফ সিদ্দিকীকে সরিয়ে দেওয়ার পর অন্য কাউকে ওই মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব না দেওয়া পর্যন্ত ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রণালয় সরাসরি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে থাকবে। প্রধানমন্ত্রীর ঘনিষ্ঠ সূত্র জানায়, ১৫ অক্টোবর ইতালি সফর শেষে দেশে ফেরার পর প্রধানমন্ত্রী এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবেন। মন্ত্রিসভায় কিছু রদবদল ও নতুন কাউকে নিয়োগ দেওয়ার ব্যাপারে সরকার ও দলে আলোচনা আছে।
সংসদ সদস্যপদ নিয়ে বিতর্ক: মন্ত্রিত্ব ও দল থেকে বাদ পড়লেও লতিফ সিদ্দিকীর সংসদ সদস্যপদ থাকবে বলে জানিয়েছেন আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত। সাবেক আইনমন্ত্রী শফিক আহমেদও মনে করেন, দলের প্রাথমিক সদস্যপদ বাতিল হলেও তিনি স্বতন্ত্র সাংসদ হিসেবে থাকবেন।
তবে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম এ ব্যাপারে ভিন্নমত পোষণ করেছেন। গতকাল রাতে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, দলের প্রাথমিক সদস্যপদ হারালে তিনি সংসদ সদস্য থাকবেন না। সে ক্ষেত্রে টাঙ্গাইলের ওই আসনে উপনির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে।
জানতে চাইলে বিশিষ্ট আইনজীবী শাহ্দীন মালিক বলেন, দল থেকে বহিষ্কার করা হলে সংসদ সদস্যপদ থাকবে কি না, সে বিষয়ে সংবিধানে স্পষ্ট বলা নেই। এখন কেউ যদি এ বিষয়ে আইনের আশ্রয় নেন, সে ক্ষেত্রে হাইকোর্টের ব্যাখ্যার মাধ্যমে বিষয়টির সুরাহা হবে।