পুঁজির একটা প্রধান প্রবণতা হচ্ছে বেশি মুনাফা এবং স্বল্প ঝুঁকিপূর্ণ ক্ষেত্রের দিকে ধাবিত হওয়া। এই নিয়মের ব্যত্যয় ঘটা হবে অস্বাভাবিকতা কিংবা ব্যতিক্রম। বাংলাদেশের বেসরকারি খাতে বিদেশি ঋণ গ্রহণের প্রবণতা বৃদ্ধি পাওয়ার কারণে পুঁজির এই সহজাত ধর্মটি নতুনভাবে উপস্থাপিত হয় আমাদের সামনে। বাংলাদেশের বড় শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলো যে আপন যোগ্যতায় বিদেশি সূত্র থেকেও ঋণ গ্রহণ করার যোগ্যতা অর্জন করেছে, তার উপযোগিতা বিচার বাদ দিলেও বাংলাদেশের মতো ভাবমূর্তির দেশের জন্য এটি শ্লাঘার বিষয়। বাংলাদেশ ব্যাংকের এক গবেষণাপত্রে দেখা যায়, ২০০৯ সাল থেকে ২০১৪ (মার্চ) পর্যন্ত দেশের দুই শতাধিক প্রতিষ্ঠানের অনুকূলে মোট ৫৫৪ কোটি ডলারের ঋণ অনুমোদন দেওয়া হয়েছে বিভিন্ন বিদেশি ঋণদাতাদের পক্ষ থেকে। বলা বাহুল্য, এই ঋণের একাংশ সাপ্লায়ার্স ক্রেডিট বা বাকি হিসেবে দেওয়া এবং বাকি অংশ চলতি মূলধন হিসেবে দেওয়া স্বল্পমেয়াদি ঋণ। এসব ঋণের একটা বড় অংশ দেশের বিভিন্ন ব্যাংকের নিশ্চয়তাপত্র কিংবা ঋণপত্রের বিপরীতে স্বীকৃত বিলের অধীনে বলে বিদেশি ঋণদাতা সংস্থার ঝুঁকি প্রায় অস্তিত্বহীন। তবে কিছু ঋণ আছে, যা গ্রহীতার সরাসরি দায়, সেখানে ব্যাংকের কোনো নিশ্চয়তা দেওয়া নেই, এটিই আমাদের শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলোর কৃতিত্ব।
বাংলাদেশ ব্যাংকের মুদ্রানীতি (জুলাই-ডিসেম্বর ২০১৪) অনুযায়ী, বেসরকারি খাতে ২০১৪ সালের মে পর্যন্ত অভ্যন্তরীণ সূত্র থেকে আগের বছরের তুলনায় ঋণপ্রবাহ বেড়েছে ১১ শতাংশ এবং বিদেশি এবং অভ্যন্তরীণ সূত্র মিলিয়ে একই সময়ে ঋণপ্রবাহ বৃদ্ধির হার ১৬ শতাংশ, অর্থাৎ বৈদেশিক সূত্র থেকে বেড়েছে ৫ শতাংশ।
এখানে খুব সংগত প্রশ্ন হতে পারে, বাংলাদেশের ব্যাংকগুলো যখন অতি তারল্যের ভারে বিনিয়োগ সমস্যায় ন্যুব্জ, সে সময় দেশের করপোরেট হাউসগুলো বিদেশি ঋণমুখী হচ্ছে কেন? এর প্রধান কারণ, বিদেশি ঋণের সুদহার অভ্যন্তরীণ ঋণবাজারের সুদের চেয়ে অনেক কম। এ ছাড়া দেশীয় ব্যাংকগুলো অনেক ক্ষেত্রে তাদের মূলধন অপর্যাপ্ততার কারণে এককভাবে বড় অঙ্কের ঋণ অনুমোদন করতে পারে না। অভ্যন্তরীণ সূত্র থেকে বিদেশি মুদ্রায় গৃহীত ঋণের স্বল্প মেয়াদও অপেক্ষাকৃত দীর্ঘমেয়াদি বিদেশি ঋণবাজারের মুখাপেক্ষী হওয়ার আর একটা কারণ হিসেবে ধরা যেতে পারে। তবে সবচেয়ে বড় কারণ সুদের হার।
সুদের এই উচ্চহার স্বাভাবিক বাজারব্যবস্থায় কমলেও আমাদের দেশের ক্ষেত্রে সেটি প্রযোজ্য হওয়ার সম্ভাবনা ক্ষীণ। আমাদের ঋণ মহার্ঘ হওয়ার কারণগুলো বিশ্লেষণ করলে বোঝা যাবে যে এই হার কমে আন্তর্জাতিক বাজারের কাছাকাছি হওয়ার সম্ভাবনা ক্ষীণ। অভ্যন্তরীণ বাজারে সুদের হার না কমার কারণগুলোর মধ্যে প্রথমটি হচ্ছে মুদ্রাস্ফীতি। আমানতের সুদহার মুদ্রাস্ফীতির হারের নিচে নামানো সম্ভব নয় বলে ঋণের সুদের হার একটা নির্দিষ্ট হারের নিচে নামবে না। দ্বিতীয়ত, খেলাপি ঋণের উচ্চহার, যা ব্যাংকের তহবিল ব্যয় বাড়িয়ে দেয়, ফলে ব্যাংকগুলো সুদের হার কমাতে অপারগ।
উচ্চ সুদের হারের এই অনমনীয়তার কারণেই স্বল্পব্যয়ের বিদেশি ঋণের ক্রমবর্ধমান নতুন ধারাটি উন্মুক্ত হয়েছে আমাদের দেশে। অন্যদিকে উন্নত বিশ্বের দেশগুলোতে পুঁজি বিনিয়োগের ক্ষেত্র পূর্ণ নিষিক্ত হয়ে পড়ার ফলে পুঁজি তার সহজাত সঞ্চরণশীল প্রবণতায় ধাবিত হচ্ছে দেশের সীমানা ছাড়িয়ে। আমাদের দেশের বেসরকারি খাতে ক্রমবর্ধমান এই বিদেশি ঋণের পক্ষে-বিপক্ষে বিভিন্ন মহলে দেখা যাচ্ছে মিশ্র প্রতিক্রিয়া। বিদেশি ঋণের বিপদ যে একেবারেই নেই সে কথা হলফ করে বলা যায় না। এই বিপদাশঙ্কার মূলে রয়েছে ১৯৯৭ সালে পূর্ব এশীয় দেশগুলোর আর্থিক সংকট, যার উৎসভূমি ছিল বিপুল পরিমাণ বিদেশি ঋণের বোঝা। তবে সেখানে যা ঘটেছিল তার সঙ্গে বাংলাদেশের নতুন এই প্রবণতার মৌলিক কিছু পার্থক্য আছে। সে সময় পূর্ব এশীয় দেশগুলোর নেওয়া বিদেশি ঋণ বিনিয়োগ করা হয়েছিল দীর্ঘমেয়াদি প্রকল্পে, যার একটা বড় অংশ ছিল আবাসন খাত। ফলে স্বল্পমেয়াদি বিদেশি ঋণ দীর্ঘমেয়াদি প্রকল্পে আটকে যাওয়ার কারণে ঋণের মেয়াদের সঙ্গে প্রকল্পগুলোর সমাপ্তির সময়ের মধ্যে দেখা দেয় চরম সমন্বয়হীনতা, যাকে ব্যাংকিং ভাষায় বলা হয় ‘ম্যাচুরিটি মিসম্যাচ’। অনুৎপাদনশীল খাতে বিনিয়োগ এবং রপ্তানি আয়হীন প্রকল্পে বিনিয়োগের কারণে এই সমস্যার সঙ্গে যুক্ত হয় স্থানীয় মুদ্রার অবমূল্যায়নের ফলে সৃষ্ট বিপদ। কারণ, অবমূল্যায়নের ফলে মহার্ঘ হয়ে ওঠা বিদেশি মুদ্রার ঋণ স্থানীয় মুদ্রায় শোধ করার সময় অপ্রত্যাশিতÿ ক্ষতির মুখোমুখি হতে হয় ঋণগ্রহীতাদের। বিদেশি ঋণ গ্রহণের এই অবিমৃশ্যকারী প্রবণতার কারণেই পূর্ব এশীয় সংকট আজকাল একটা দৃষ্টান্তে পরিণত হয়েছে।
উন্নত দেশ থেকে ঋণ গ্রহণের এই প্রবণতা বিষয়ে মার্কিন অর্থনীতিবিদ রবার্ট লুকাস ১৯৯০ সালে এক প্রশ্ন তুলে বসেন যে অর্থনীতির সূত্রমাফিক পুঁজিপ্রবাহ উন্নত দেশ থেকে স্বল্পোন্নত দেশের দিকে ধাবিত হওয়ার কথা, কারণ পুঁজির অপ্রতুলতার কারণে অনাবিষ্কৃত বিনিয়োগ সম্ভাবনা থাকে বলে স্বল্পোন্নত দেশগুলোতে উন্নত দেশের তুলনায় পুঁজির উৎপাদনশীলতা বেশি। ফলে সেসব দেশে পুঁজির প্রবাহ বাড়লে তাদের উন্নয়ন ও প্রবৃদ্ধি নিশ্চিত হয়। কিন্তু বাস্তবে সেটি ঘটে না। লুকাসের এই প্রশ্নের যৌক্তিক ব্যাখ্যা পাওয়া যায় আইএমএফের একটা ত্রৈমাসিক (মার্চ ২০০৭) প্রকাশনায়। এতে বলা হয়েছে, উন্নয়নশীল দেশগুলোতে অবকাঠামোগত সমস্যা, অপ্রশিক্ষিত বা স্বল্পশিক্ষিত মানবসম্পদ, দুর্নীতি, বৈদেশিক ঋণখেলাপের প্রবণতা ইত্যাদি কারণে বিনিয়োগের উৎপাদনশীলতা কমে যায়। এতে বলা হয়েছে, পুঁজি যদি উন্নয়নশীল দেশগুলোতে যায়ও, তা যাওয়ার কথা দ্রুত উন্নয়নশীল দেশগুলোতে। কিন্তু বাস্তবে তাও যায় না। এটির কারণ বিশ্লেষণের জন্য আইএমএফ ৫৯টি দেশের ওপর এক সমীক্ষা চালিয়ে ১৯৭০-২০০৪ সময়ের প্রবণতা পরীক্ষা করে এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছে যে ম্যাক্রো-অর্থনৈতিক উপাত্ত ব্যবহার করে বেসরকারি পুঁজিপ্রবাহের সঙ্গে প্রবৃদ্ধির জোরদার কোনো সম্পর্ক প্রতিষ্ঠিত করা যায় না। এই সমীক্ষাপত্রে আরও মন্তব্য করা হয়েছে, যেসব দেশ বিদেশ থেকে বেশি ঋণ গ্রহণ করে, তাদের অভ্যন্তরীণ সঞ্চয়ের ওপর নির্ভর করতে হয় না বলে বেশি বিনিয়োগ করতে সক্ষম হয়, আর তাই তাদের প্রবৃদ্ধিও হয় দ্রুততর।
মজার বিষয়, ২০০৭-এর জানুয়ারি পর্যন্ত আইএমএফের প্রধান ইকোনমিস্ট, পরবর্তী সময়ে ভারতীয় রিজার্ভ ব্যাংকের গভর্নর রঘুরাম রাজন তাঁর ফল্ট লাইনস গ্রন্থে ঠিক উল্টো কথা লেখেন, একটি দেশ যত বেশি তার নিজস্ব সম্পদ বা সঞ্চয় থেকে বিনিয়োগ করে, সে দেশের প্রবৃদ্ধি তত দ্রুত হয়। যে দেশ প্রয়োজনের চেয়ে কম সঞ্চয় করে বা অতিরিক্ত বিনিয়োগ করে, সে দেশের জন্য বিদেশি অর্থায়ন প্রয়োজন হতেই পারে। এটাও ঠিক যে বিনিয়োগ বেশি হলে উন্নয়নও বেশি হবে। তবে এই বিনিয়োগ যদি বিদেশি অর্থায়নে ঘটে তাহলে প্রবৃদ্ধির গতি হবে শ্লথ।
আমাদের বেসরকারি খাতের বিদেশি ঋণ