মহানবী (সা.), হজ ও তাবলিগ জামাত নিয়ে আপত্তিকর মন্তব্য করে বিতর্কের কেন্দ্রে থাকা আবদুল লতিফ সিদ্দিকীকে কেন দল থেকে বহিষ্কার করা হবে না- এ মর্মে কারণ দর্শাতে চিঠি দিয়েছে আওয়ামী লীগ। গতকাল আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলামের স্বাক্ষর করা এ চিঠি লতিফ সিদ্দিকীর টাঙ্গাইলের গ্রামের বাড়ির ঠিকানায় পাঠানো হয়েছে। রাজধানীর জিগাতলা পোস্ট অফিস থেকে রেজিস্ট্রি ডাকে কালিহাতির স্থায়ী ঠিকানায় পাঠানো নোটিশের জবাব সাত দিনের মধ্যে দিতে বলা হয়েছে। এতে দলের প্রেসিডিয়ামের পদ থেকে তাকে অব্যাহতির বিষয়টিও উল্লেখ করা হয়। এদিকে লতিফ সিদ্দিকীর সংসদ সদস্য থাকা না থাকা নিয়ে বিতর্ক চলছেই। গতকাল জাতীয় সংসদের চিফ হুইপ আসম ফিরোজ সংবাদ সম্মেলন করে জানিয়েছেন, আওয়ামী লীগের সদস্য পদ হারালেও লতিফ সিদ্দিকী সংবিধান অনুযায়ী এমপি পদ হারাবেন না। তবে এ বিষয়ে স্পিকার দেশে এলেই চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হবে। লতিফ সিদ্দিকীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে সরকারকে দেয়া ইসলামী দলগুলোর আলটিমেটাম আজ শেষ হচ্ছে। পরবর্তী কর্মসূচি ঠিক করতে গতকাল তারা বৈঠক করেছেন।
গত রোববার আওয়ামী লীগের কার্যনির্বাহী সংসদের বৈঠকে দলের প্রেসিডিয়াম থেকে লতিফ সিদ্দিকীকে অব্যাহতি দেয়া হয়। দলের প্রাথমিক সদস্য পদও স্থগিত রাখার সিদ্ধান্ত হয় বৈঠকে। বৈঠকে নেয়া সিদ্ধান্তের আলোকেই লতিফ সিদ্দিকীকে কারণ দর্শানোর নোটিশ পাঠানো হয়েছে। সংগঠনের আদর্শ ও শৃঙ্খলাবিরোধী কর্মকাণ্ডে জড়িত থাকার অভিযোগের কথা উল্লেখ করা হয়েছে নোটিশে। আওয়ামী লীগের গঠনতন্ত্রের ৪৬ ‘ঞ’ অনুচ্ছেদে অনুযায়ী তাবে দলের সদস্য পদ থেকে বহিষ্কারের প্রক্রিয়া চলছে। এ অনুচ্ছেদে বলা আছে, ‘সংগঠনের যে কোন শাখা তাহার যে কোন কর্মকর্তা বা সদস্যকে দলের স্বার্থ, আদর্শ, শৃঙ্খলা তথা গঠনতন্ত্র ও ঘোষণাপত্র পরিপন্থি কর্মকাণ্ডের জন্য স্ব-স্ব পদ বা দায়িত্ব হইতে অব্যাহতি প্রদান করিতে পারিবে। তবে এ ব্যাপারে ঊর্ধ্বতন শাখার অনুমোদন প্রয়োজন হইবে এবং এই ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট শাখার সাধারণ সভায় দুই তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যের মতামতের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত গৃহীত হইবে। ঊর্ধ্বতন শাখা পরববর্তী ১ মাসের মধ্যে তাহার সিদ্ধান্ত সংশ্লিষ্ট শাখাকে জানাইবে, অন্যথায় সিদ্ধান্তের সহিত একমত বলিয়া গণ্য হইবে।’ এদিকে দলের পরবর্তী সিদ্ধান্ত নিতে আগামী ২৪শে অক্টোবর কার্যনির্বাহী সংসদের পরবর্তী সভা আহ্বান করা হয়েছে। দলের দপ্তর সম্পাদক আবদুস সোবহান গোলাপ স্বাক্ষরিত এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে গতকাল এ তথ্য জানানো হয়।
এমপি পদ নিয়ে সিদ্ধান্ত নেবেন স্পিকার
মন্ত্রিপরিষদ থেকে অব্যাহতি পাওয়া আবদুল লতিফ সিদ্দিকীর সংসদ সদস্য পদ থাকবে কিনা সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবেন স্পিকার। বিদেশ সফর শেষে দেশের ফেরার পর তিনি এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত জানাবেন বলে জানিয়েছেন সরকার দলীয় চিফ হুইপ আ স ম ফিরোজ। গতকাল সংসদ সচিবালয়ের মিডিয়া সেন্টারে এক প্রেস বিফ্রিংয়ে তিনি একথা জানান। চিফ হুইপ বলেন, লতিফ সিদ্দিকীর সংসদ সদস্যপদ আপাতত থাকছে। সংসদ সদস্যপদ বাতিলের বিদ্যমান যে বিধান আছে, তা তার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়। কারণ তিনি দলের বিরুদ্ধে ভোট দেননি বা পদত্যাগও করেননি। এমনকি দলীয় সিদ্ধান্তের বাইরে সংসদে কিছু করেননি। এ কারণে তার বিষয়টি ফ্লোর ক্রসিং-এ পড়েনি। এ নিয়ে মন্ত্রীদের ব্যাখ্যা সম্পর্কে জানতে চাইলে চিফ হুইপ বলেন, লতিফ সিদ্দিকীকে নিয়ে যে জটিলতার সৃষ্টি হয়েছে, সে বিষয়ে সংবিধান বা সংসদের কার্যপ্রণালী বিধিতে সুস্পষ্টভাবে কিছু বলা নেই। তাই এ বিষয়ে কোন বিতর্ক দেখা দিলে সেই বিতর্ক অবসানে স্পিকার সিদ্ধান্ত নেবেন। প্রয়োজনে তিনি আইনজ্ঞদের পরামর্শ নেবেন। স্পিকার ড. শিরিন শারমিন চৌধুরী কমনওয়েলথ পার্লামেন্টারি এসোসিয়েশনের (সিপিএ) নির্বাহী কমিটির চেয়ারম্যান নির্বাচিত হওয়ায় জাতীয় সংসদের পক্ষ থেকে সংবর্ধনা অনুষ্ঠানের প্রস্তুতির বিষয়ে ওই প্রেস ব্রিফিং-এর আয়োজন করা হয়। স্পিকার আগামী ২১শে অক্টোবর দেশে ফিরবেন। পরদিন ২২শে অক্টোবর সংসদ ভবনের দক্ষিণ প্লাজায় ওই সংবর্ধনা অনুষ্ঠানের আয়োজনের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। গতকাল মঙ্গলবার বেলা ১১টায় সংসদ ভবনে ডেপুটি স্পিকার ফজলে রাব্বী মিয়ার সভাপতিত্বে সংবর্ধনা অনুষ্ঠানের প্রস্তুতিমূলক বৈঠক হয়।
ইসলামপন্থিদের আলটিমেটাম
পদচ্যুত মন্ত্রী আবদুল লতিফ সিদ্দিকীর গ্রেপ্তার ও ফাঁসির দাবিতে সম্মিলিত ইসলামী দলসমূহের দেয়া আলটিমেটাম শেষ হচ্ছে আজ। এ পর্যায়ে ২৬শে অক্টোবর সারা দেশে সকাল-সন্ধ্যা হরতাল পালন শেষে লাগাতার কর্মসূচির কথা ভাবছেন আন্দোলনকারীরা। ১লা অক্টোবর রাজধানীর বায়তুল মোকাররম মসজিদের উত্তর গেটে বিক্ষোভ সমাবেশ থেকে এ আলটিমেটাম দেয় ১১ দলের সমন্বয়ে গঠিত সম্মিলিত ইসলামী দল। তবে জাতীয় পার্টি, জামায়াতে ইসলামী, খেলাফত আন্দোলন, খেলাফত মজলিসসহ অন্যান্য দল লতিফ সিদ্দিকীর ফাঁসির দাবি জানায়। লতিফ সিদ্দিকীর নাগরিকত্ব বাতিলের দাবি জানায় ইসলামী আন্দোলন। এদিকে ২৬শে অক্টোবরের হরতাল-পরবর্তী করণীয় নিয়ে গতকাল সম্মিলিত ইসলামী দলের অস্থায়ী কার্যালয়ে এক জরুরি বৈঠক হয়। এতে নেতৃবৃন্দ বলেন, মুরতাদ লতিফ সিদ্দিকী মহানবী (সা.), পবিত্র হজ ও তাবলীগ জামাত নিয়ে কটূক্তি করে বিশ্ব মুসলিম উম্মাহর বুকে আগুন জ্বালিয়েছেন। তারপরও কোন শক্তির ইশারায় তিনি নিজেকে ধর্মদ্রোহী ঘোষণা দেয়ার দম্ভোক্তি করার স্পর্ধা দেখালেন। তার এ ক্ষমার অযোগ্য বক্তব্য প্রত্যাহার এবং জাতীর কাছে নিঃশর্ত ক্ষমা চাইতে হবে। এছাড়া তাকে বেঁধে দেয়া সময়ের মধ্যে আইনের আওতায় এনে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা না নিলে অবরোধ সহ কঠোর কর্মসূিচ চলতে থাকবে। মাওলানা মুহিউদ্দীন খানের সভাপতিত্বে বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন মাওলানা আবদুল লতিফ নেজামী, অধ্যক্ষ মাওলানা যাইনুল আবেদীন, মাওলানা জাফরুল্লাহ খান, মাওলানা আবু তাহের জিহাদী, মাওলানা মুহিউদ্দীন রব্বানী, ড. মাওলানা খলিলুর রহমান মাদানী প্রমুখ। সভায় বলা হয়, স্বঘোষিত ধর্মদ্রোহী, মুরতাদ লতিফ সিদ্দিকীকে মন্ত্রিসভা ও আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম পদ থেকে বরখাস্ত করার সিদ্ধান্তকে আমরা মোবারকবাদ জানাই। তবে মুরতাদ হিসেবে লতিফ সিদ্দিকীকে এখনই আইনের আওতায় এনে সর্বোচ্চ শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। ইসলামে মুরতাদের শাস্তি মৃত্যুদণ্ড। হাদীস শরীফে বলা হয়েছে ‘যে মুরতাদ হয়ে যাবে তাকে হত্যা করো’। অতএব সরকারের দায়িত্বই হলো তাকে গ্রেপ্তারের কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করা, যাতে আর কোন কুলাঙ্গার, ধর্মদ্রোহী, নাস্তিক, মুরতাদ, ইসলামের বিরুদ্ধে কথা বলার দুঃসাহস দেখাতে না পারে। বৈঠকে আগামীকাল সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে পরবর্তী কর্মসূচি ঘোষণার সিদ্ধান্ত হয়। এদিকে ইসলামী ঐক্যজোটের শিল্প ও বাণিজ্য সম্পাদক মাওলানা যুবায়ের আহমদ বলেছেন, ধর্মীয়, সাংবিধানিক, জাতিসংঘের নীতি এবং মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে অত্যন্ত গর্হিত ওই ঔদ্ধত্যপূর্ণ মন্তব্যের অপরাধে আল্লাহদ্রোহী নরাধম, মুরতাদ আবদুল লতিফকে শরীয়ত অনুযায়ী ফাঁসির রায় কার্যকর করতে সরকারকে ব্যবস্থা নিতে হবে। মুরতাদের ঠাঁই বাংলাদেশে হবে না। তিনি কার সবুজ সংকেত পাওয়ার আশা করেছেন জানি না। কিন্তু যে বা যারাই তাকে সবুজ সংকেত দেবে তাদের ঠাঁইও বাংলাদেশে হবে না। একই দলের সহকারী মহাসচিব মাওলানা আবুল কাশেম বলেছেন, আবদুল লতিফ সিদ্দিকীর ধৃষ্টতাপূর্ণ মন্তব্যে দেশে ক্ষোভের আগুন জ্বলছে। এ আগুন জ্বলতে থাকবে মুরতাদের ফাঁসি না হওয়া পর্যন্ত। ধর্ম অবমাননা এবং মুরতাদের শরিয়া নির্ধারিত ফাঁসির বিধান সংবলিত আইন করে তার বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা নিতে হবে। জমিয়তে উলামায়ে ইসলামের সভাপতি শায়েখ আবদুল মোমিন, নির্বাহী সভাপতি মাওলানা মোস্তফা আজাদ, প্রচার সেক্রেটারি ওয়ালী উল্লাহ আরমান এক বিবৃতিতে বলেছেন, লতিফ সিদ্দিকী কলকাতায় বসে ধর্মদ্রোহী হওয়ার হুঙ্কার ছুড়ে ইসলামের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছেন। ইতিপূর্বে সরকারের অন্যান্য মন্ত্রী ইসলাম, কোরান, মাদরাসা শিক্ষা বিষয়ে প্রকাশ্যে কুৎসা ও বিদ্রুপ করেছেন। তাদের উৎসাহে নাস্তিক-মুরতাদেরা আস্ফালন দেখিয়েছে। সুতরাং, কেবল মন্ত্রিসভা ও দলীয় পদবি থেকে তাকে বাদ দিলেই চলবে না- বরং, তাকে ইন্টারপোলের সাহায্যে ধরে এনে কঠিন শাস্তির সম্মুখীন করতে হবে। সেই সঙ্গে নবী-রসূল ও ধর্ম অবমাননাকারীদের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ডের বিধান রেখে আইন প্রণয়ন করতে হবে। ইসলামপ্রেমী জনতা শান্তিতে বিশ্বাসী। কিন্তু এ বিষয়ে সরকারের টালবাহানায় দেশে কোন কঠিন পরিস্থিতির সৃষ্টি হলে তার দায়ভার সরকারকেই বহন করতে হবে। মুরতাদ লতিফ সিদ্দিকীর নাগরিকত্ব বাতিলসহ সর্বোচ্চ শাস্তির দাবি জানিয়েছে ইসলামী আন্দোলনের নায়েবে আমীর মুফতি সৈয়দ মোহাম্মদ ফয়জুল করীম। তিনি বলেন, স্বঘোষিত ধর্মদ্রোহী, মুরতাদ ও নাস্তিক লতিফ সিদ্দিকীর ব্যাপারে কোন প্রকার ছাড় দেয়া হবে না। সরকার যদি ইসলামের প্রতি ন্যূনতম দরদ অনুভব করে তাহলে লতিফকে সর্বোচ্চ শাস্তির বিধান প্রণয়ন করতেই হবে। গতকাল পুরানা পল্টনে দলীয় এক সভায় তিনি এসব কথা বলেন। অধ্যক্ষ মাওলানা ইউনুছ আহমাদের পরিচালনায় সভায় বক্তব্য রাখেন অধ্যাপক আশরাফ আলী আকন, মাওলানা গাজী আতাউর রহমান, মাওলানা ইমতিয়াজ আলম, মাওলানা আহমদ আবদুল কাইয়ূম, প্রিন্সিপাল মাওলানা আতাউর রহমান আরেফী, মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাকী প্রমুখ। এদিকে গতকাল সকাল ৯টা থেকে ইসলামী আন্দোলনের কেন্দ্রীয় কার্যালয় পুলিশ অবরুদ্ধ করে রাখে বলে দলের পক্ষ থেকে দাবি করা হয়। এ সময় নেতৃবৃন্দকে পুলিশ অফিসে ঢুকতে ও বের হতে বাধা দেয়। এ ঘটনায় নেতৃবৃন্দ ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন। লতিফ সিদ্দিকীর নাগরিকত্ব বাতিলসহ সর্বোচ্চ শাস্তির দাবীতে ইসলামী আন্দোলন আজ দুপুরে পুরানা পল্টন কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনের ডাক দিয়েছে। সংগঠনের নায়েবে আমীর মুফতি সৈয়দ মোহাম্মদ ফয়জুল করীম সংবাদ সম্মেলনে বক্তব্য দেবেন।