দুই বছরের বেশি সময় বন্ধ থাকার পর মধ্যপ্রাচ্যের দেশ সংযুক্ত আরব আমিরাতে (ইউএই) বাংলাদেশের জন্য শ্রমবাজার আবার উন্মুক্ত হতে হচ্ছে। পাশাপাশি বাংলাদেশের নাগরিকদের ভিসার ক্ষেত্রে বিধিনিষেধের অবসানও ঘটতে যাচ্ছে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আসন্ন সংযুক্ত আরব আমিরাত সফরে গুরুত্বপূর্ণ এসব অগ্রগতি হবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন বাংলাদেশের কর্মকর্তারা। প্রধানমন্ত্রী তিন দিনের সফরে ২৫ অক্টোবর দেশটিতে যাচ্ছেন। সফরকালে তিনি সংযুক্ত আরব আমিরাতের প্রধানমন্ত্রী শেখ মোহাম্মদ বিন রশিদ আল মাখতুমের সঙ্গে দুবাইতে দ্বিপক্ষীয় বৈঠক করবেন। এ ছাড়া আবুধাবিতে জাতির মাতা ফাতিমা বিন মুবারক আল কেতবি ও যুবরাজ মোহাম্মদ বিন জায়েদ আল নাহিয়ানের সঙ্গে বৈঠক করবেন।
কূটনীতিকেরা বলছেন, অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে বাংলাদেশিদের জড়িয়ে পড়ায় দেশটিতে বাংলাদেশের ভাবমূর্তির যে সংকট তৈরি হয়েছিল, প্রধানমন্ত্রীর এই সফরে নিরাপত্তা সহযোগিতা ও বন্দিবিনিময়ের চুক্তি সইয়ের মধ্য দিয়ে ঢাকা এই সংকট কাটিয়ে উঠতে সক্ষম হবে। পাশাপাশি আরব আমিরাতের মধ্যে এই আস্থা তৈরি হবে যে অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়া কর্মীদের ব্যাপারে দায় নিতে বাংলাদেশ তৈরি আছে।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও সংযুক্ত আরব আমিরাতে বাংলাদেশ দূতাবাসের কর্মকর্তারা গতকাল বুধবার প্রথম আলোকে জানান, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার এ সফরের সময় দুই দেশের মধ্যে জনশক্তি নিয়োগের ব্যাপারে জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরো (বিএমইটি) ও আমিরাতের একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে সমঝোতা স্মারক সই হবে। এ ছাড়া নিরাপত্তা সহযোগিতা ও বন্দিবিনিময়ের ব্যাপারে দুই দেশের মধ্যে অন্য দুটি চুক্তি সইয়ের কথা রয়েছে।
আমিরাতে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত মোহাম্মদ ইমরান গতকাল রাতে মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, প্রধানমন্ত্রীর সফরের মধ্য দিয়ে শ্রমবাজার ও ভিসাই নয়, সামগ্রিকভাবেই সংযুক্ত আরব আমিরাতের সঙ্গে সম্পর্ক সম্প্রসারণের সুযোগ উন্মুক্ত হবে।
জানা গেছে, মূলত বাংলাদেশের নাগরিকদের অপরাধমূলক কাজে জড়িয়ে পড়ার হার বেড়ে যাওয়ায় ২০১২ সালের আগস্টে আমিরাতে কর্মসংস্থান ভিসা প্রায় বন্ধ হয়ে যায়। গত বছরের নভেম্বরে বন্ধ হয় ব্যবসায়ী ও পর্যটক ভিসা। বিশেষ পরিস্থিতিতে শুধু ঢাকার দূতাবাসের মাধ্যমে শর্ত সাপেক্ষে ভিসা দেওয়া হয়েছে।
প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রণালয় ও আরব আমিরাতের বাংলাদেশ দূতাবাস সূত্রে জানা গেছে, ২০০৬ সালে এক লাখ ৩০ হাজার ২০৪ জন, ২০০৭ সালে দুই লাখ ২৬ হাজার ৩৯২ জন, ২০০৮ সালে চার লাখ ১৯ হাজার ৩৫৫ জন, ২০০৯ সালে দুই লাখ ৫৮ হাজার ৩৪৮ জন, ২০১০ সালে দুই লাখ তিন হাজার ৩০৮ জন, ২০১১ সালে দুই লাখ ৮২ হাজার ৭৩৯ জন, ২০১২ সালে দুই লাখ ১৫ হাজার ৪৫২ জন বাংলাদেশি ইউএইতে গেছেন। কিন্তু ২০১৩ সালে হঠাৎ বাংলাদেশিদের ভিসা দেওয়া প্রায় বন্ধ হয়ে যাওয়ায় সে বছর মাত্র ১৪ হাজার ২৪১ জন এবং চলতি বছর এ পর্যন্ত ১৭ হাজার ৫০৫ জন বাংলাদেশি দেশটিতে গেছেন।
প্রবাসী বাংলাদেশিরা জানান, বর্তমানে ১২ থেকে ১৫ লাখ বাংলাদেশি এখানে রয়েছেন। বেশির ভাগ বাংলাদেশি ভালো হলেও কেউ কেউ বিভিন্ন অপরাধে জড়িয়ে পড়েছেন। নানা অপরাধে কয়েকজন বাংলাদেশির মৃত্যুদণ্ডের রায় এবং প্রায় ১০০ জনের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হয়েছে। কাজেই আবার বাজার চালু হলে বাংলাদেশিরা যেন কোনো অপরাধে না জড়ান, সে ব্যাপারে সতর্ক থাকতে হবে।
জানা গেছে, এবারের সফরে শেখ হাসিনা আরব আমিরাতের উত্তরাঞ্চলের রাস আল খায়মাহ যাবেন। তিনি সেখানকার বিনিয়োগকারীদের বাংলাদেশে বিনিয়োগ বাড়ানোর বিষয়ে আলোচনা করবেন।
প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থানমন্ত্রী খন্দকার মোশাররফ হোসেন, পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ এইচ মাহমুদ আলী ও স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান প্রধানমন্ত্রীর সফরসঙ্গী হিসেবে যাচ্ছেন।
জনশক্তি রপ্তানিকারকেরা বলছেন, কুয়েত, সৌদি আরব, মালয়েশিয়া ও লিবিয়ার পর আরব আমিরাতের বাজারটি বন্ধ হয়ে যাওয়ায় জনশক্তি রপ্তানিতে বড় ধরনের বিপর্যয় নেমে আসে। এর মধ্যে সরকারের রাজনৈতিক অদূরদর্শিতায় দুবাইয়ের ওয়ার্ল্ড এক্সপো-২০২০ সামনে রেখে রাশিয়াকে সমর্থন দিলে ক্ষুব্ধ হয় আরব আমিরাত। তবে সেই অবস্থান থেকে সরে এসে পরে আরব আমিরাতকে ভোট দিলে পরিস্থিতি কিছুটা স্বাভাবিক হয়। এর পরও ভিসা বন্ধ থাকায় বাংলাদেশিরা যেমন দেশটিতে যেতে পারছেন না, তেমনি সেখানে থাকা বাংলাদেশিরাও নানা সংকটে পড়ছেন।
দ্বিতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় এসে আমিরাতে জনশক্তি রপ্তানি স্বাভাবিক করতে সরকারের পক্ষ থেকে নানা উদ্যোগ নেওয়া হয়। বিশেষ করে ওয়ার্ল্ড এক্সপো-২০২০ সামনে রেখে দেশটিতে যে কর্মযজ্ঞ হবে, সে উদ্দেশ্যে বাংলাদেশি কর্মী নেওয়ার আহ্বান জানানো হয় সরকারের পক্ষ থেকে। এ পরিস্থিতিতেই আমিরাত সরকারের পক্ষ থেকে প্রধানমন্ত্রীকে আমিরাত সফরের আমন্ত্রণ জানানো হয়।