রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা বাংলাদেশ চিনি ও খাদ্যশিল্প করপোরেশনের (বিএসএফআইসি) আওতাধীন চিনিকলগুলোর গুদামে মজুত প্রায় ১০ হাজার টন চিনি নষ্ট হতে বসেছে। মিল কর্তৃপক্ষ এ বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে বিএসএফআইসিতে চিঠি পাঠিয়েছে।
কয়েক বছর ধরে গুদামে অবিক্রীত অবস্থায় পড়ে থাকায় এ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। ঠিক কী পরিমাণ চিনি নষ্ট হয়ে যাচ্ছে, কোনো চিনিকল কর্তৃপক্ষ তা চিঠিতে উল্লেখ করেনি।
করপোরেশনের একাধিক কর্মকর্তা প্রথম আলোকে জানিয়েছেন, গুদামে যথাযথভাবে সংরক্ষণ করা হলে উৎপাদিত চিনির মান ১২ থেকে ১৫ মাস পর্যন্ত ভালো থাকে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে তা দুই বছর পর্যন্ত ভালো রাখা সম্ভব।
সূত্র বলছে, মিলগুলোতে এখনো ২০১১-১২ আখ মাড়াই মৌসুমে উৎপাদিত চিনিও অবিক্রীত পড়ে আছে। এমন চিনির পরিমাণ প্রায় ১০ হাজার টন। এই চিনিটাই নষ্ট হয়ে যাচ্ছে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
উল্লিখিত মৌসুমে প্রতি কেজি চিনির উৎপাদন ব্যয় ছিল ৭৫ থেকে ৮০ টাকা। সে হিসাবে, ওই চিনি উৎপাদনে চিনিকলগুলোর ব্যয় হয়েছে ৭৫ থেকে ৮০ কোটি টাকা। আর বর্তমানে দেশীয় চিনিকলের চিনি বিক্রির দর নির্ধারণ করা আছে ৪০ টাকা। সে হিসাবে, এই চিনির বাজারমূল্য এখন ৪০ কোটি টাকা।
এ বিষয়ে কেরু অ্যান্ড কোংয়ের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) আজিজুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘প্রত্যেকটা খাদ্যপণেরই জীবনকাল থাকে। চিনিরও আছে। আমাদের কাছে থাকা চিনি এখনো খাওয়ার উপযোগী আছে। তবে মান নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। যত দিন যাবে এর মান আরও নষ্ট হবে।’
এ বিষয়ে করপোরেশনের চেয়ারম্যান মাহমুদুল হক ভুঁইয়ার সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি সংস্থাটির সচিবের সঙ্গে কথা বলার পরামর্শ দেন। তবে সচিব এস এম আবদার হোসেনের সঙ্গে কথা বলা সম্ভব হয়নি।
চিনিকল করপোরেশন সূত্র বলছে, বর্তমানে তাদের কাছে অবিক্রীত পড়ে আছে এক লাখ ৪৬ হাজার ৭০০ টন চিনি। এর মধ্যে চলতি ২০১৩-১৪ আখ মাড়াই মৌসুমে উৎপাদিত চিনি আছে প্রায় ৯০ হাজার টন। এর বাইরে ২০১২-১৩ মৌসুমের প্রায় ৫০ হাজার টন এবং ২০১১-১২ মৌসুমের ১০ হাজার টন চিনিও পড়ে আছে।
তিন বছর ধরেই করপোরেশনের আওতায় উৎপাদিত চিনি বিক্রি হচ্ছে কম। সে কারণে ২০১১ সালের সেপ্টেম্বর থেকে এ পর্যন্ত চিনির বিক্রয়মূল্য চার দফায় কমানো হয়েছে। দাম কমালে চিনি বিক্রি হবে—এমন পর্যবেক্ষণ থেকে দাম কমানো হলেও কোনো ফল হয়নি। ২০১১ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর সরকারি চিনির দাম নির্ধারণ করা হয় ৬০ টাকা কেজি। সে বছরই আরেক দফা চিনির দাম কমিয়ে ৫৫ টাকা করা হয়। পরের বছর ১৯ জুলাই সরকার চিনির দাম নির্ধারণ করে ৫০ টাকা। সর্বশেষ এ বছরের ৯ ফেব্রুয়ারি দাম নির্ধারণ করা হয় ৪০ টাকা।
সূত্র জানায়, দাম কমানোর পর থেকে এখন পর্যন্ত ৮৬ হাজার ৯৮৪ টন চিনি বিক্রি হয়েছে। এর বড় অংশই বিক্রি হয়েছে ফ্রি সেলে (যার ইচ্ছা সে চিনি কিনতে পারবে)। চিনি বিক্রি হচ্ছে না দেখে গত মে মাসে শিল্প মন্ত্রণালয় ফ্রি সেলে এক লাখ টন চিনি বিক্রির অনুমতি দেয়। কিন্তু করপোরেশনের ডিলারেরা কোনো চিনি তুলছেন না।
জানতে চাইলে বাংলাদেশ চিনি ডিলার অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মোস্তাফিজুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘সরকার ৪০ টাকা দর বেঁধে দিয়েছে। কিন্তু বাজারে চিনির পাইকারি দর ৩৮ থেকে ৩৯ টাকা। তাহলে আমরা কীভাবে এই চিনিটা বিক্রি করব? চিনি করপোরেশনে আমাদের চার হাজার ডিলারের জামানত হিসেবে ৪০ কোটি টাকা পড়ে আছে। ওই টাকাটা ব্যাংকে রাখলেও তো কিছু সুদ পেতাম।’ তিনি জানান, গত দুই বছর ধরে সরকার চিনির যে দরই নির্ধারণ করে, তার চেয়ে কম দামে বেসরকারি মিলগুলো তাদের চিনি বিক্রি করে। ফলে সরকারি চিনি তুললে লোকসান গুনতে হয়।
করপোরেশন সূত্র বলছে, চলতি মৌসুমে প্রতি কেজি চিনি উৎপাদনে খরচ পড়েছে ৭৭ থেকে ৮০ টাকা। কিন্তু বিক্রয়মূল্য ৪০ টাকা। ফলে প্রতি কেজি চিনিতে অন্তত ৩৭ টাকা লোকসান গুনতে হবে। মজুত চিনি বিক্রি না হওয়ায় চিনি নষ্ট হয়ে যাচ্ছে—এমন তথ্য উল্লেখ করে করপোরেশনের কাছে এ মাসেই নর্থ বেঙ্গল চিনিকল, জয়পুরহাট চিনিকল, কেরু অ্যান্ড কোংসহ কয়েকটি চিনিকল চিঠি দিয়েছে। চিনিকলগুলো বলেছে, ইতিমধ্যে অনেক চিনির রং নষ্ট হয়ে গেছে। দ্রুত চিনি বিক্রির ব্যবস্থা না নেওয়া হলে এসব চিনি আর বেশি দিন ধরে রাখা যাবে না।
নর্থ বেঙ্গল চিনিকলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মাহবুবুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ২০১২-১৩ মৌসুমের কিছু চিনির রং নষ্ট হয়ে গেছে। কিন্তু তা এখনো খাওয়ার উপযোগী আছে। কিন্তু এভাবে অবিক্রীত পড়ে থাকলে বেশি দিন চিনির মান ভালো থাকবে না। ওই চিনিকলে এখন ২৫ হাজার টন চিনি মজুত আছে, যার বাজারমূল্য ১০০ কোটি টাকা বলে জানান তিনি।
এই অবস্থায় আগামী নভেম্বর থেকে ২০১৪-১৫ আখ মাড়াই মৌসুমের চিনির উৎপাদন শুরু হতে যাচ্ছে।
চিনিকলগুলোর কর্তৃপক্ষ বলছে, এখনকার মজুত চিনিই গুদামে রাখা যাচ্ছে না। সেখানে নতুন মৌসুমের চিনি উঠলে তা কোথায় রাখা হবে, সে নিয়ে দুশ্চিন্তায় আছে কর্তৃপক্ষ। আর গুদামে যথাযথভাবে সংরক্ষণ করা না গেলে নতুন চিনিও দ্রুত নষ্ট হওয়ার আশঙ্কা থেকে যায়। সে কারণে চিনিকলগুলো নতুন গুদাম তৈরির প্রস্তাবও দিয়েছে।
সূত্র বলছে, করপোরেশনের আওতাধীন ১৫টি চিনিকলের মধ্যে ঝিলবাংলা এবং শ্যামপুর চিনিকলের অবস্থা ভালো। ঝিলবাংলায় এক হাজার ২০০ টন এবং শ্যামপুরে এক হাজার ৭০০ টন চিনি মজুত পড়ে আছে। বাকি চিনি বিক্রি হয়ে গেছে। সেনাবাহিনী ও পুলিশ বেশি চিনি কেনে বলে ওই দুই চিনিকলের চিনি বিক্রি হয়েছে বেশি।
সরকারি ১৫ চিনিকলের চিত্র
যথাযথভাবে সংরক্ষণ করলে চিনির গুণগত মান ১২ থেকে ১৫ মাস পর্যন্ত ভালো থাকে। সরকারি চিনিকলে এখনো ২০১১-১২ মৌসুমে উৎপাদিত প্রায় ১০ হাজার টন চিনি পড়ে আছে।
বিভিন্ন চিনিকল করপোরেশনে চিঠি দিয়ে চিনি নষ্ট হওয়ার আশঙ্কার কথা জানিয়েছে