দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় (ঢাবি)। প্রাচ্যের অক্সফোর্ড খ্যাত এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটিতে একের পর এক ঘটছে যৌন নির্যাতনের ঘটনা। খোদ বিশ্ববিদ্যালয়টির শিক্ষকদের লালসার শিকার হচ্ছেন শিক্ষার্থীরা। গত পাঁচ বছরেই অন্তত ২০টি যৌন নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে। কিন্তু সুষ্ঠু বিচার হয়নি একটিরও। এসব কেলেঙ্কারির ঘটনায় তদন্ত কমিটি হলেও প্রভাবশালী মহলের অদৃশ্য ইশারায় পার পেয়ে যান অভিযুক্তরা। থেকে যান বহাল তবিয়তে। এ কারণে এসব ঘটনার পুনরাবৃত্তি হচ্ছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামের ইতিহাস বিভাগের শিক্ষক মাহমুদুর রহমান বাহলুল। ২০১০ সালে থেকে বিয়ের প্রলোভন দেখিয়ে ওই বিভাগের দুই ছাত্রীর সঙ্গে শারীরিক সম্পর্ক গড়ে তোলেন তিনি। ২০১৩ সালে অন্য মেয়েকে বিয়ে করতে গেলে বেরিয়ে আসে থলের বেড়াল। ফাঁস হয়ে যায় লম্পট ওই শিক্ষকের অপকর্ম। ভিসি বরাবর অভিযোগ করেন ওই দুই ছাত্রী। অভিযোগের প্রেক্ষিতে গঠিত হয় তদন্ত কমিটি। এক বছরের জন্য অব্যাহতি দেয়া হয় বিভাগের সকল কর্মকা- থেকে। তদন্ত করে প্রমাণ পায় গঠিত কমিটি। সুপারিশ করে সর্বোচ্চ শাস্তি। কিন্তু এখানেই শেষ। রাজনৈতিক কারণে তার বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। প্রমোশন দিয়ে ওই শিক্ষককে করা হয় সহকারী প্রক্টর। পাশাপাশি সূর্যসেন হলের আবাসিক শিক্ষক। সমপ্রতি বিভাগে যোগদানের জন্য আবেদন করেছেন তিনি। সর্বশেষ ছাত্রলীগ কর্মীদের চুরির ঘটনায় তদন্ত কমিটিতেও রাখা হয়েছে তাকে। গত ১৫ই সেপ্টেম্বর নাট্যকলা বিভাগের চতুর্থ বর্ষের এক ছাত্রীকে যৌন হয়রানির অভিযোগে ওই বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. সাইফুল ইসলামকে সাময়িক বরখাস্ত করেছে বিশ্ববিদ্যালয় সিন্ডিকেট। সব ধরনের শিক্ষা কার্যক্রম থেকে অব্যাহতি দেয়া হয়। তবে ভুক্তভোগী ছাত্রীর সহপাঠীরা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিদ্ধান্তকে প্রত্যাখ্যান করে ওই শিক্ষকের স্থায়ী চাকরিচ্যুতির দাবি জানিয়ে আন্দোলনে নামে। ১৫ দিন পর গঠন করা হয় তদন্ত কমিটি। অনেকটা দায়মুক্তি দিতেই এতদিন পর এই গঠিত হয় তদন্ত কমিটি। বিশ্ববিদ্যালয়ের আরবি বিভাগের শিক্ষক এটিএম ফখরুল ইসলাম। তার বিভাগের ৩য় বর্ষের এক ছাত্রীর সঙ্গে একই ছাদের নিচে বসবাস করেন দীর্ঘদিন। বিষয়টি গড়ায় শিক্ষকের পরিবার পর্যন্ত। হাতেনাতে ধরাও পড়েন তারা। ইট দিয়ে ছাত্রীর মাথা ফাটান। পরে কিছুদিন শিক্ষক এবং কথিত দ্বিতীয় স্ত্রী পালিয়ে থাকেন। ওই শিক্ষক আবার ক্যাম্পাসে এলেও ওই ছাত্রীটিকে আর দেখা যায়নি। তদন্ত কমিটি হলেও এখন পর্যন্ত তার বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। একই অভিযোগ ফার্সি বিভাগের শিক্ষক ড. আবু মূসা আরিফ বিল্লাহ বিরুদ্ধে। কলা ভবনের ৪র্থ তলায় কথা বলার সময় এক ছাত্রীকে হঠাৎ জড়িয়ে ধরেন তিনি। এরপর ওই ছাত্রীর শরীরের স্পর্শকাতর স্থানে হাত দিতে থাকেন ওই শিক্ষক। এসময় অন্য ছাত্রীরা এসে তাকে উদ্ধার করেন। কিন্তু লজ্জায় ওই ছাত্রী আর ক্যাম্পাসে আসেননি। তবে ওই শিক্ষক আছেন বহাল তবিয়তে। ঘটনা তদন্তে তদন্ত কমিটি গঠন হলেও তা আলোর মুখ দেখেনি। পরিসংখ্যান, প্রাণ পরিসংখ্যান ও তথ্য পরিসংখ্যান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. জাফর আহমেদ খানের বিরুদ্ধে পরকীয়া, নিপীড়ন ও যৌতুকের অভিযোগ আনেন তারই স্ত্রী। তিনি জাফরের বিরুদ্ধে একাধিক ছাত্রীর সঙ্গে অনৈতিক সম্পর্ক রয়েছে বলে অভিযোগ করেন। ২০০৯ সালে রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক গিয়াস উদ্দিন মোল্লার বিরুদ্ধে এক ছাত্রী যৌন হয়রানির অভিযোগ আনেন। এরপর ওই শিক্ষককে এক বছর একাডেমিক কার্যক্রম থেকে অব্যাহতি দেয়া হয়। ২০১০ সালে ট্যুরিজম অ্যান্ড হসপিটালিটি ম্যানেজমেন্ট বিভাগের তখনকার চেয়ারম্যান অধ্যাপক আফজাল হোসেনের বিরুদ্ধে শিক্ষার্থীকে যৌন নির্যাতনের অভিযোগ ওঠে। ২০১১ সালে উর্দু বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ড. ইসরাফিলের বিরুদ্ধে যৌন হয়রানির অভিযোগ তোলেন এক শিক্ষার্থী। ২০০৯ সালে ফারসি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগের শিক্ষক মুমিত আল রশিদের বিরুদ্ধে ওই বিভাগেরই এক ছাত্রী তার স্ত্রী দাবি করেন। একইভাবে রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক এমরান হোসেন, মৎস্য বিজ্ঞান বিভাগের মাহমুদ হাসান, সমাজবিজ্ঞান বিভাগের আমানুল্লাহ ফেরদৌস, ফিন্যান্স বিভাগের অধ্যাপক মো. সালাহউদ্দিন চৌধুরী, ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক এসএম মফিজুর রহমান, মো. জাকারিয়া, মনোবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. কামাল উদ্দিনের বিরুদ্ধে নানা অভিযোগে তদন্ত কমিটি হলেও রিপোর্ট অপ্রকাশিত রয়ে গেছে। এছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ে বিভিন্ন ঘটনায় তদন্ত কমিটি গঠিত হলেও প্রভাবশালী মহলের চাপের কারণে অনেক সময় প্রতিবেদন প্রকাশিত হলেও লঘু শাস্তি দিয়ে ছেড়ে দেয়ার অভিযোগ রয়েছে। উর্দু বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক জাফর আহমেদ ভূইয়ার বিরুদ্ধে পরীক্ষার্থীর খাতায় লিখে দেয়ার অভিযোগ উঠে। এ ঘটনায় তদন্ত কমিটি গঠিত হলেও কমিটির সদস্য ড. এএম আমজাদকে জানানো হয়নি বলে তিনি দাবি করেন। পরবর্তীতে ফাইলটি হারিয়ে যায় বলে জানা যায়। এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি ড. আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক বলেন, তদন্ত একটি সময় সাপেক্ষ প্রক্রিয়া। তাই রিপোর্ট প্রকাশ ও শাস্তি বাস্তবায়নে কিছু সময় লাগে। একটি কমিটি অভিযুক্ত শিক্ষকের সর্বোচ্চ শাস্তির সুপারিশ করলেও তা এখনও কেন বাস্তবায়ন করা হয়নি জানতে চাইলে তিনি বলেন, কাগজপত্র দেখে এ বিষয়ে কথা বলতে হবে।
পাঁচ বছর পর কমিটি: দেশের উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও বিশ্ববিদ্যালয়ে যৌন নিপীড়নের ঘটনা তদন্তে ২০০৯ সালে যৌন নিপীড়ন বিরোধী তদন্ত কমিটি গঠন করার নির্দেশ দেয় আদালত। হাইকোর্টের নির্দেশনার পাঁচ বছর পর বুধবার এ সংক্রান্ত কমিটি করেছে প্রতিষ্ঠানটি। তবে এর আগেও একটি কমিটি ছিল বলে দাবি তাদের। তবে গত পাঁচ বছরে এ কমিটি একটি মিটিং করতে পারেনি।