বিনিয়োগ স্থবিরতায় ব্যাংকে আমানতের সুদের হার কমিয়ে দেয়া হচ্ছে। নানা সুযোগ-সুবিধা দেয়া হচ্ছে সঞ্চয়পত্রে। অধিক মুনাফার আসায় আমানতকারীরা সঞ্চয়পত্রসহ বিভিন্ন খাতে বিনিয়োগ করছেন। ফলে ব্যাংকে কমে যাচ্ছে আমানতের পরিমাণ। এদিকে, ব্যাংক থেকে সরকার দীর্ঘমেয়াদি ঋণ নিচ্ছে। ফলে দীর্ঘ দিনের জন্য ব্যাংকের টাকা আটকে যাচ্ছে সরকারের কোষাগারে। ব্যাংকাররা জানিয়েছেন, সামনে বিনিয়োগ পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে এলে অর্থাৎ বিনিয়োগ চাহিদা বৃদ্ধি পেলে ব্যাংকের বিনিয়োগ করার মতো তহবিল হাতে থাকবে না। তারা জানিয়েছেন, দীর্ঘ দিন ধরেই বিনিয়োগ চাহিদা নেই। এতে ব্যাংকে টাকার চাহিদা কমে গেছে; কিন্তু উচ্চ সুদ বা মুনাফা পরিশোধ করতে হচ্ছে আমানতকারীদের। এতে ব্যাংকের তহবিল ব্যবস্থাপনা ব্যয় বেড়ে চলছে। পরিস্থিতি মোকাবিলায় ব্যাংক ৩টি পথ বেছে নিয়েছে। আমানতকারীদের নিরুৎসাহিত করতে আমানতের সুদের হার বা মুনাফার হার কমিয়ে দিচ্ছে। স্বল্প সুদে আমানত নিয়ে উচ্চ সুদের বিশেষ আমানত ফেরত দিচ্ছে। অলস টাকা কমাতে সরকারকে ৫ বছর থেকে ২০ বছর মেয়াদে ঋণ দিচ্ছে। এভাবে ব্যাংক তহবিল ব্যবস্থাপনা ব্যয় কমানোর চেষ্টা করছে। এসবের ফলে ব্যাংকে আমানত দ্রুত কমে যাচ্ছে। আমানতকারীরা ব্যাংক থেকে আমানত প্রত্যাহার করে বিনিয়োগ করছেন সঞ্চয়পত্র কিংবা বিভিন্ন কো-অপারেটিভে। কেউ কেউ পুঁজিবাজারের মতো ঝুঁকিপূর্ণ খাতেও বিনিয়োগ করছেন। এ ছাড়া সরকারের দীর্ঘমেয়াদি ঋণ দেয়ায় ভবিষ্যতে ব্যাংকের নগদ টাকার সংকট বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা থেকে যাচ্ছে। একটি বেসরকারি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক জানান, তার ব্যাংকে প্রচুর উদ্বৃত্ত তহবিল রয়েছে, যা তিনি বিনিয়োগ করতে পারছেন না। বিনিয়োগ করতে না পারায় এ টাকা এখন ব্যাংকের জন্য বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছে। পরিস্থিতি মোকাবিলায় তিনি আমানতে সুদের হার কমিয়ে দিচ্ছেন। ব্যাংকে আমানতের সুদের হার কমিয়ে দিলেও সঞ্চয়পত্রে সুযোগ-সুবিধা বাড়িয়ে দেয়া হচ্ছে। গত সপ্তাহে এ বিষয়ে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের বরাত দিয়ে ব্যাংকগুলোর জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক এক সার্কুলার জারি করেছে। এতে পেনশনার সঞ্চয়পত্র ও ওয়েজ আর্নার্স ডেভেলপমেন্ট বন্ডের ওপর আয়করের হার শিথিল করা হয়েছে। এতে পেনশনার সঞ্চয়পত্র ও ওয়েজ আর্নার্স ডেভেলপমেন্ট বন্ডে ৫ লাখ টাকা পর্যন্ত বিনিয়োগের সুদ আয় করমুক্ত করা হয়েছে। তবে ৫ লাখ টাকার অধিক বিনিয়োগের সুদের ওপর ৫% হারে উৎসে কর বহাল রাখা হয়েছে। ব্যাংকাররা জানিয়েছেন, ব্যাংকিং খাতে আমানতের সুদের হার ১০ শতাংশের নিচে নামিয়ে আনা হলেও সঞ্চয়পত্রে সুদের হার ১২ শতাংশের ওপরে বহাল রাখা হয়েছে। পাশাপাশি ৫ লাখ টাকা পর্যন্ত বিনিয়োগের সুদ আয় করমুক্ত রাখায় ব্যাংকের ছোট ছোট আমানতকারী ব্যাংক থেকে টাকা উত্তোলন করে অধিক মুনাফার জন্য সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ করছেন। এর ফলে সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগের হার অস্বাভাবিক হারে বেড়ে গেছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরিসংখ্যানে দেখা যায়, গত আগস্ট মাসে সঞ্চয়পত্র নিট বিক্রির হার আগের বছরের একই সময়ের চেয়ে ২৫৮% বৃদ্ধি পেয়েছে। গত বছরের আগস্টে সঞ্চয়পত্রে নিট বিনিয়োগ হয়েছিল ৬৯১ কোটি টাকা, যা গত আগস্টে বেড়ে হয়েছে ২৪৭১ কোটি টাকা। সঞ্চয়পত্র প্রত্যাহারের হারও কমে গেছে। গত বছরের জুলাই-আগস্টে সঞ্চয়পত্র মোট বিক্রি হয়েছিল ৩৮৬৯ কোটি টাকার ও প্রত্যাহার হয়েছিল ২০৫২ কোটি টাকা। সেখানে গত জুলাই ও আগস্টে মোট বিক্রি হয়েছে ৬২৭১ কোটি টাকা আর প্রত্যাহার হয়েছে ১৯৪৩ কোটি টাকা। বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যানে আরও দেখা যায়, গত বছরের জুলাইয়ে সামগ্রিক আমানতের প্রবৃদ্ধি হয়েছিল ১৭%, সেখানে গত জুলাইয়ে তা নেমে হয়েছে সোয়া ১৬%। এ পরিস্থিতিতে সামনে তহবিল সংকটের আশঙ্কা করছেন ব্যাংকাররা। তাদের মতে, সামনে বিনিয়োগ বাড়তে পারে। পরিস্থিতির পরিবর্তন হলে বিনিয়োগকারীরা বিনিয়োগমুখী হবেন। তখন ব্যাংকে টাকার চাহিদা বেড়ে যাবে; কিন্তু রাতারাতি আমানত বাড়ান যাবে না। ফলে বর্ধিত হারে বিনিয়োগ করার মতো তহবিল থাকবে না।