এক সময় ছিল যখন দেশে শুধুমাত্র একটা চ্যানেল ছিল বিটিভি। আর এ চ্যানেলে বেশ কয়েকটি নাচের অনুষ্ঠানই প্রচার হতো। অথচ এখন এত টিভি চ্যানেল। কিন্তু সে তুলনায় নাচ খুব অবহেলিত ছোট পর্দায়। অবশ্য চ্যানেলগুলো যে নাচের অনুষ্ঠান একেবারেই প্রচার করে না, তা কিন্তু নয়। তবে সেটা বিশেষ দিনগুলোকে ঘিরে। আর এ অনুষ্ঠানগুলোতে দেখা যায় না কোন পেশাদার নৃত্যশিল্পীকে। এতে কি দর্শক তাদের তৃষ্ণা মেটাতে পারেন-এমন প্রশ্ন বেশ জোরালো নৃত্যশিল্পীদের মনে। ঈদ, পহেলা বৈশাখ কিংবা বিজয় দিবস অর্থাৎ বিশেষ দিনগুলো ছাড়া দু-একটি চ্যানেল ব্যতিরেকে আর কাউকেই বছরজুড়ে নাচের অনুষ্ঠান প্রচার করতে দেখা যায় না। এ নিয়ে নৃত্যশিল্পীদের পাশাপাশি দর্শক মহলেও অতৃপ্তি লক্ষ্য করা যায়। ছোট পর্দায় নৃত্যশিল্পের অবহেলা নিয়ে বিশিষ্ট নৃত্যশিল্পী শিবলী মোহাম্মদ বলেন, কথা হচ্ছে সময় নিয়ে। একটি নাচের অনুষ্ঠান প্রচার করার সময় একটা বড় বিষয়। দর্শক যে সময় তাদের ব্যস্ততা বা বিশ্রামের মধ্যে কাটান সে সময় দেখা যায় নৃত্যানুষ্ঠান প্রচার হয়। তাও তো দেখাচ্ছে বিটিভি। বেশ ক’বছর ধরে বিটিভি তাদের ‘তারানা’ অনুষ্ঠানটি প্রচার করে আসছে। এজন্য তাদের একটা বিশেষ ধন্যবাদও দিচ্ছি। অন্যদিকে প্রাইভেট চ্যানেলগুলো নাচের অনুষ্ঠান নির্মাণের ব্যাপারে একেবারেই উদাসীন। বছরের বিশেষ দিনগুলো ছাড়া তারা নৃত্যানুষ্ঠান করে না বললেই চলে। অবশ্য যেটা প্রচার করে তা নিয়েও রয়েছে আমার প্রশ্ন। ঈদ কিংবা বিশেষ দিনে নায়িকা কিংবা মডেলদের দিয়ে নাচের অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। তাদের ধারণা, এদের দিয়ে নৃত্য পরিবেশন করালেই হয়তো টেলিভিশনের রেটিং পয়েন্ট (টিআরপি) বেড়ে যাবে। কিন্তু এতো কষ্ট করে যেসব ছেলেমেয়ে নাচ শিখছে কিংবা যারা পেশাদার নৃত্যশিল্পী তাদের কি হবে? এরা কোথায় যাবে? এজন্য সচেতন হতে হবে সবাইকে। টিভি চ্যানেলে অন্য অনুষ্ঠানের পাশাপাশি নৃত্যশিল্পও যেন যুগ যুগ ধরে বেঁচে থাকে সে কামনাই করি। এদিকে বিশিষ্ট নৃত্যশিল্পী মুনমুন আহমেদ বলেন, এখন তো আগের মতো টেলিভিশনে নাচের অনুষ্ঠান প্রচার হয় না বললেই চলে। আমরা বার বার অনুষ্ঠান বাড়ানোর ব্যাপারে বলে আসছি। কিন্তু এ বিষয়ে কারও কোন ইতিবাচক সাড়া পাওয়া যাচ্ছে না। অন্যান্য অনুষ্ঠান প্রচার নিয়েই চ্যানেলগুলো বেশি ব্যস্ত বলে মনে হচ্ছে। যে কারণে দর্শকের মন থেকে একটু একটু করে নৃত্যশিল্পের জায়গাটি মুছেও যাচ্ছে। এটা আমাদের নৃত্যশিল্পের জন্য সত্যিই হুমকিস্বরূপ। বিশেষ দিনগুলো ছাড়া এখন আর টিভি চ্যানেলগুলো নাচের অনুষ্ঠান প্রচার করে না। দুই একটি চ্যানেলে মাঝে মাঝে দেখা যায়। কিন্তু আরও তো ২০টিরও বেশি চ্যানেল রয়েছে। এসব চ্যানেলে নাচের অনুষ্ঠান হয়ই নয়। অবশ্য এজন্য তাদের কারও কারও অবকাঠামোগত সমস্যাও রয়েছে। বেশ কিছু চ্যানেল একটি ফ্ল্যাটবাড়ি ভাড়া করে চ্যানেল কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছেন। নিজস্ব কোন স্টুডিও নেই। ফলে তারা এ ধরনের অনুষ্ঠান নির্মাণ করতেও পারেন না। অবশেষে আমি বলবো, চ্যানেলগুলোর নৃত্যানুষ্ঠান বাড়ানোর বিষয়ে সচেতন হওয়া উচিত। নৃত্যশিল্প যেন হারিয়ে না যায় সে ব্যাপারে তারা সদয় দৃষ্টি দেবে এমনটাই প্রত্যাশা আমার। বিশিষ্ট নৃত্যশিল্পী শামীম আরা নিপা বলেন, এসব নিয়ে প্রায়ই আমরা বলে আসছি। কিন্তু এই বলাতে আর কিছুই হচ্ছে না। চ্যানেলগুলো বাণিজ্যিক মনোভাব নিয়েই চলছে। যে কারণে নাচের অনুষ্ঠানের ব্যাপারে স্পন্সর না পেলে তারা আর সে অনুষ্ঠান নির্মাণ করতে পারে না। আসলে নৃত্যের এ শিল্পটিকে বাঁচিয়ে রাখার ব্যাপারে কারও দায়বদ্ধতা নেই বললেই চলে। সব মিলিয়ে বলতে চাই, সদিচ্ছার অভাব রয়েছে সবার। ইচ্ছে করলেই সব করা যায়। এই তো গেল বিশিষ্টজনদের কথা। এবার আসা যাক চ্যানেলের অনুষ্ঠান প্রধানদের কাছে। তাদের কি মত? এ ব্যাপারে আরটিভির অনুষ্ঠান প্রধান দেওয়ান শামসুর রকিব বলেন, আসলে আমরাও চাই নৃত্যানুষ্ঠান সব সময় দর্শক দেখুক। কিন্তু একটা সমস্যা হলো, আমরা তো চাইলেই অনেক কিছু করতে পারি না। দেখুন, একটি নৃত্যানুষ্ঠান প্রচার করতে অনেক আয়োজন লাগে। সংগীতানুষ্ঠান করতে গেলে খুব স্বল্প পরিসরেই করা যায়। নাচের জন্য আলাদা কস্টিউম থেকে শুরু করে অনেক কিছুর ব্যবস্থা করতে হয়। যে কারণে নাচের অনুষ্ঠান করতে স্পন্সররাও তেমন আগ্রহ প্রকাশ করেন না। অবশ্য একেবারে যে প্রচার হচ্ছে না তা কিন্তু নয়। বিশেষ দিনগুলোতে কিন্তু নৃত্যানুষ্ঠান প্রচার হয়েই থাকে। বাংলাভিশনের অনুষ্ঠান প্রধান শামীম শাহেদ এ প্রসঙ্গে বলেন, নাচের অনুষ্ঠান বাড়ছে। কমে গেছে বা হারিয়ে যাচ্ছে বললে ভুল হবে। গেল ঈদের অনুষ্ঠানেও বাংলাভিশনে ৬টি নৃত্যানুষ্ঠান প্রচার হয়েছে। হ্যাঁ, এটা ঠিক যে বছরজুড়ে নৃত্যানুষ্ঠান করা হয় না। আর তা সম্ভবও হয় না। একটি নাচের অনুষ্ঠান নির্মাণ করতে শ্রম, সময় ও অনেক অর্থের দরকার। যা বছরজুড়ে করা সম্ভবও নয়। আর আমি মনে করি নাচের মতো সম্মানজনক একটি শিল্পকে বিশেষভাবেই মর্যাদা দেয়া উচিত। সেই সঙ্গে যারা নাচের নাম করে তথাকথিত শিল্পী দিয়ে নাচের অনুষ্ঠান নির্মাণ করেন তাদের সমালোচনাও আমি করি। এ বিষয়ে এটিএন বাংলার প্রোগ্রাম ও ট্রান্সমিশনের সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট তাশিক আহমেদ বলেন, নাচের অনুষ্ঠান কমেনি বা সংস্কৃতির এ জায়গাটিকে কোনভাবে অবহেলাও করা হচ্ছে না। আমরা আমাদের চ্যানেল দিয়েও যদি বিচার করি তাহলে দেখা যাবে এটিএন বাংলা ছোট ও বড় সবার নাচের অনুষ্ঠান প্রচার করে থাকি। আমার কাছে যেটা মনে হয়, প্রচারে কোথাও ঘাটতি রয়েছে। এছাড়া কোন সমস্যা রয়েছে বলে আমার মনে হয় না।