বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দামে নিম্নগতি লক্ষ করা যাচ্ছে। গত জুন থেকে অক্টোবর পর্যন্ত সময়ে তেলের দাম প্রায় ২৫ শতাংশ কমে গেছে। এ নিয়ে চিন্তিত প্রধান তেল উত্পাদনকারী দেশ বিশেষ করে রাশিয়া, ভেনেজুয়েলাসহ প্রধান তেল উত্পাদনকারী দেশগুলো। কারণ, এতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হতে পারে তাদের। অন্যদিকে এতে লাভবান হতে পারে বিশ্বে জ্বালানি তেলের সবচেয়ে বড় ভোক্তা হিসেবে পরিচিত যুক্তরাষ্ট্রসহ তেল আমদানিকারক দেশগুলো।
লন্ডন থেকে প্রকাশিত দ্য ইকোনমিস্ট-এর এ-সংক্রান্ত এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম তেল উত্পাদনকারী দেশ রাশিয়ায় ‘ইউক্রেন সংকট’ চলছে। তেল উত্পাদনকারী দেশ ইরাক, সিরিয়া, নাইজেরিয়া ও লিবিয়া অস্থিতিশীল। প্রথম দুটিতে চলছে আইএস-বিরোধী অভিযান। এমন এক পরিস্থিতিতে বিশ্ববাজারে অপরিশোধিত জ্বালানি তেলের দাম গত মধ্য জুন থেকে মধ্য অক্টোবর পর্যন্ত প্রতি ব্যারেলে ২৫ শতাংশ কমে গেছে। মধ্য জুনে প্রতি ব্যারেল অপরিশোধিত তেলের দাম ছিল ১১৫ ডলার, যা মধ্য অক্টোবরে দাঁড়িয়েছে ৮৫ ডলারের নিচে।
আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) টম হেলব্লিং মনে করেন, বিশ্ববাজারে তেলের দাম কমায় প্রধানত লাভবান হবে বিশ্ব অর্থনীতি। তাঁর মতে, তেলের দাম ১০ শতাংশ পরিবর্তন বৈশ্বিক জিডিপিতে ০ দশমিক ২ শতাংশ প্রভাব ফেলে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জ্বালানি তেলের দাম কমে যাওয়ায় একদিকে কিছু দেশ যেমন লাভবান হবে, তেমনি কিছু দেশের ক্ষতিও হবে। তাঁরা বলছেন, বিশ্বে প্রতিদিন নয় কোটি ব্যারেল তেল উত্পাদন হয়। এ ক্ষেত্রে প্রতি ব্যারেলের দাম ১১৫ ডলার হিসাবে এক বছরে উত্পাদিত তেলের দাম দাঁড়ায় ৩.৮ ট্রিলিয়ন ডলার। অন্যদিকে প্রতি ব্যারেলের দাম ৮৫ ডলার হলে এই দাম দাঁড়াবে ২.৮ ট্রিলিয়ন ডলারে।
ইকোনমিস্ট-এর প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম তেল আমদানিকারক দেশ চীন। ২০১৩ সালের তথ্য অনুযায়ী ব্যারেলপ্রতি এক ডলার তেলের দাম কমায় বছরে চীনের সাশ্রয় হয় ২১০ কোটি ডলার। সাম্প্রতিক দরপতন অব্যাহত থাকলে দেশটির আমদানি খরচ কমবে ছয় হাজার কোটি ডলার। চীনের সবচেয়ে বড় রপ্তানি খাত হলো শিল্পজাত পণ্য। এই সময়ে এসব পণ্যের দাম কমেনি। এই পরিস্থিতি অব্যাহত থাকলে চীনের বিদেশি মুদ্রার রিজার্ভ আরও বেড়ে যাবে এবং জীবনযাত্রার মান উন্নত হবে। চীনের জিয়ামেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক লিন বোকিয়াংয়ের মতে, জ্বালানির দাম কমায় সরকারের ভর্তুকি কমবে। একই সঙ্গে গাড়িচালকদের ৭০ শতাংশ বেশি বেতন দিতে পারবেন গাড়ির মালিকেরা।
অন্যদিকে জ্বালানি তেলের দাম কমায় যুক্তরাষ্ট্রে মিশ্র প্রভাব পড়তে পারে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। তাঁদের মতে, যুক্তরাষ্ট্র একাধারে জ্বালানি তেলের সবচেয়ে বড় ভোক্তা, আমদানিকারক ও উত্পাদক। তাই কম দামে তেল কিনে যতটা লাভবান হওয়ার আশা করা হচ্ছে, যুক্তরাষ্ট্র ঠিক ততটা লাভবান না-ও হতে পরে। গোল্ডম্যান স্যাকসের বিশ্লেষকদের মতে, তেলের দাম কমায় ও সুদের হার কম থাকায় ২০১৫ সালে যুক্তরাষ্ট্রে দশমিক ১ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হবে। তবে শক্তিশালী ডলার, ঋণাত্মক বৈশ্বিক প্রবৃদ্ধি এবং দুর্বল শেয়ারবাজার এ ক্ষেত্রে ভারসাম্য আনতে পারে।
যুক্তরাষ্ট্র যেহেতু সবচেয়ে বড় তেল আমদানিকারক দেশ, তাই তেলের দাম কমে গেলে তাদের অধিক অর্থ সাশ্রয় হবে। তারা এই অর্থ দেশের জন্য খরচ করতে পারবে।
তেলের দাম কমার কারণে ভারতেরও আমদানি খরচ কমবে, মূল্যস্ফীতি কমে যাবে এবং জ্বালানিতে ভর্তুকি কমে যাওয়ায় বাজেট ঘাটতি কমে আসবে। ভারত সরকার ইতিমধ্যে সে দেশে কয়েক দফায় জ্বালানি তেলের দাম কমিয়েছে।
অন্যদিকে জ্বালানি তেলের দাম কমায় বিশ্বের অন্যতম বড় তেল উত্পাদনকারী দেশ সৌদি আরব ধাক্কা সামলে উঠতে পারলেও বড় ধরনের প্রভাব পড়বে ভেনেজুয়েলা, ইরান ও রাশিয়ার ওপর। যদিও ভেনেজুয়েলার প্রেসিডেন্ট নিকোলাস মাদুরো গত ১৬ অক্টোবর ঘোষণা দিয়েছেন, ‘তেলের দাম কমলেও আমরা আমাদের জনগণের সামাজিক নিরাপত্তার নিশ্চয়তা দিচ্ছি।’ তবে জনগণের সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিতের কথা বলা হলেও ডচে ব্যাংকের হিসাব অনুযায়ী সরকারের ব্যয়ের পরিকল্পনা বাস্তবায়নে প্রতি ব্যারেল তেলের দাম কমপক্ষে ১২০ ডলার হতে হবে। গত বছর তাদের বাজেট ঘাটতি ছিল জিডিপির ১৭ শতাংশ। রয়েছে বড় আকারের ঋণ।
ভেনেজুয়েলার চেয়ে খারাপ অবস্থানে রয়েছে বিশ্বের অন্যতম তেল উত্পাদনকারী দেশ ইরান। এমনিতে ইরানের ওপর বিশ্ব সম্প্রদায়ের নানা অবরোধ রয়েছে। এ অবস্থায় দেশটির ব্যয়ের পরিকল্পনা অনুযায়ী অর্থ জোগান দিতে হলে প্রতি ব্যারেল তেলের দাম হতে হবে ১৩৬ ডলার। এ অবস্থায় বড় ধরনের ক্ষতিতে পড়তে পারে ইরান। গত বছর ভোক্তাদের ভর্তুকি বাবদ ইরানের খরচ হয়েছে ১০০ বিলিয়ন ডলার, যা ইরানের জিডিপির ২৫ শতাংশ।
তেলের দাম কমায় সবচেয়ে বেশি প্রভাব পড়বে বিশ্বের অন্যতম শক্তিধর দেশ রাশিয়ার ওপর। ২০১৫ সালের প্রস্তাবিত বাজেটে প্রতি ব্যারেল তেলের দাম ১০০ ডলার ধরা হয়েছে। এর নিচে নামলে দেশটির খরচ চালানো প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের জন্য কষ্টসাধ্য হয়ে পড়বে। ১৯৮০-র দশকের মধ্যভাগে একই ধরনের সমস্যায় পড়েছিল রাশিয়া। বর্তমানে রাশিয়ার বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ৪৫৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। অন্যদিকে ডলারের বিপরীতে রুবলের দামে নিম্নগতি। এ ক্ষেত্রে তেলের দাম ৮০-৮৫ ডলার হলে আগামী অর্থবছরে রাশিয়াকে জিডিপর প্রায় ১ শতাংশ বাজেট ঘাটতিতে পড়তে হবে।
আপাতদৃষ্টিতে তেলের দামের নিম্নগতি তেল আমদানিকারকদের জন্য ইতিবাচক ফল বয়ে আনলেও রপ্তানিকারকদের জন্য নেতিবাচক ফল বয়ে আনবে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকেরা। তবে তেলের দাম যদি প্রতি ব্যারেল ৮৫ ডলারে স্থির থাকে, তাহলে তেল নিয়ে নতুন করে চিন্তাভাবনা করতে হবে। তেল-নীতিতেও আনতে হবে পরিবর্তন।