দেশে শিশু অধিকার রক্ষায় আইন আছে, কিন্তু এর যথাযথ প্রয়োগ বা বাস্তবায়ন নেই। ফলে প্রতিনিয়ত ক্ষুণ্ন হচ্ছে শিশুর অধিকার। লঙ্ঘিত হচ্ছে জাতিসংঘ শিশু অধিকার সনদ।
বাংলাদেশে শিশু সুরক্ষায় জাতীয় শিশুনীতি, শিশুশ্রম নীতিমালাসহ সরকার বেশ কিছু আইন ও নীতি প্রণয়ন করেছে। কিন্তু তারপরও রাজনৈতিক কাজে শিশুদের ব্যবহার, ধর্ষণ, এসিড সন্ত্রাসের শিকারসহ বেড়েছে শিশু নির্যাতনের নানান ঘটনা। শিশু অধিকার কর্মীরা বলছেন, এসব আইন ও নীতিমালার বাস্তবিক প্রয়োগ না থাকায় শিশুদের ভাগ্যের কোনো পরিবর্তন হচ্ছে না। অগ্রগতি থেকে যাচ্ছে কাগজে-কলমে। জাতিসংঘ শিশু অধিকার সনদে অনুসমর্থনকারী দেশ হিসেবে সরকার জাতিসংঘের শিশু অধিকার সনদ (সিআরসি) বাস্তবায়নে দায়বদ্ধ। শিশু অধিকারের সার্বিক অবস্থা জানিয়ে প্রতি পাঁচ বছর পর পর জাতিসংঘ শিশু অধিকার কমিটির কাছে জবাবদিহিও করতে বাধ্য সরকার। অনুসমর্থনের পর ১৯৯৭ সালে সরকার জাতিসংঘ কমিটির কাছে প্রথম প্রতিবেদন পাঠায়। ২০০৩ সালে দ্বিতীয় এবং ২০০৭ সালে একসঙ্গে তৃতীয় ও চতুর্থ প্রতিবেদন পাঠায়।
অগ্রগতি কাগজে-কলমে: ২০০৯ সালে তৃতীয় ও চতুর্থ প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে কমিটির প্রকাশ করা উদ্বেগ এবং সুপারিশগুলো কতটুকু বাস্তবায়িত হয়েছে তা জানিয়ে সরকার গত বছর পঞ্চম প্রতিবেদন পাঠায়। সেই প্রতিবেদনে ঘুরে-ফিরে ‘করছি, ‘করব’ বা ‘প্রক্রিয়াধীন’ শব্দগুলো বলে সরকারকে পার পেতে হয়েছে। পঞ্চম প্রতিবেদনে জাতীয় শিশুনীতি, শিশুশ্রমনিরসন নীতিসহ বেশ কিছু আইন ও নীতি প্রণয়নের কথা বলা হয়েছে। তবে আইন ও নীতির বাস্তবায়নের চিত্র নেই এতে।
এ বিষয়ে আইন ও সালিশ কেন্দ্রের শিশু অধিকার ইউনিটের সিনিয়র উপপরিচালক গীতা চক্রবর্তী বলেন, শিশু অধিকার রক্ষায় সরকারের অগ্রগতি আগের তুলনায় বেড়েছে। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অবস্থান ভালো। তবে এই ভালোর অধিকাংশই কাগজে-কলমে। সম্প্রতি ইউনিসেফ ‘দক্ষিণ এশিয়ায় শিশু অধিকারের ২৫ বছর :শিশুদের জীবনমান উন্নয়ন, ভবিষ্যৎ গঠন’ শিরোনামে প্রকাশিত প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছে, বাল্যবিয়ের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ শীর্ষে অবস্থান করছে। এখানে প্রতি তিনজন মেয়ের মধ্যে একজনের বিয়ে ১৮ বছরের আগে হয়ে থাকে।
বাল্যবিয়ের এই ভয়াবহ পরিস্থিতির মধ্যে গত ১৫ সেপ্টেম্বর মন্ত্রিসভার বৈঠকে ছেলেদের বিয়ের বয়স কমিয়ে ১৮ ও মেয়েদের ১৬ করা যায় কি-না তা পরীক্ষা করে দেখার বিষয় আলোচিত হয় এবং ‘বাল্যবিবাহ রোধ আইন-২০১৪’ অনুমোদন দেওয়া হয়। এরপর বিভিন্ন মহলে এমন প্রশ্ন ওঠে_ ‘বাল্যবিবাহ রোধ আইন-২০১৪’ এর সঙ্গে ‘শিশুনীতি-২০১৩’ সাংঘর্ষিক। জাতিসংঘ শিশু অধিকার সনদ অনুসারে ১৮ বছরের কম বয়সী প্রত্যেককেই শিশু হিসেবে গণ্য করা হয়।আইন করে ঝুঁকিপূর্ণ শিশুশ্রম নিষিদ্ধ করা হলেও শিশুরা ভয়াবহ শারীরিক ও মানসিক ঝুঁকির মধ্যে কাজ করছে। শিশুশ্রম নিরসনের অঙ্গীকার করা সত্ত্বেও এই মুহূর্তে শিশু শ্রমিকের সংখ্যা কত সে তথ্যই সরকারের হাতে নেই।
মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের কর্মসূচির ব্যবস্থাপক আবদুল্লাহ আল মামুন বলেন, শিশু অধিকার সনদটি দেশে কতটুকু বাস্তবায়িত হচ্ছে তা দেখার জন্য প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো নেই। মহিলাবিষয়ক অধিদপ্তর থাকলেও শিশুদের জন্য কোনো অধিদপ্তর নেই। বেসরকারি সংস্থাসহ যারা শিশুর অধিকার নিয়ে কাজ করছে, তাদের জবাবদিহির কোনো জায়গা নেই।
হাইকোর্টের নির্দেশনা থাকা সত্ত্বেও রাজনৈতিক কাজে শিশুদের ব্যবহার বন্ধ হয়নি। বিভিন্ন জাতীয় দৈনিক থেকে সংগ্রহ করা তথ্যের ভিত্তিতে শিশু অধিকার ফোরামের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এ বছর জানুয়ারি থেকে নভেম্বর পর্যন্ত শিশু সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে এক হাজার ২৮৭টি। এর মধ্যে ধর্ষণের ঘটনা ৭৫টি, ধর্ষণের চেষ্টা ১৮টি, ধর্ষণ-পরবর্তী হত্যা ৯টি, ধর্ষণ-পরবর্তী আত্মহত্যা ৯টি। হত্যার ঘটনা ঘটেছে ২১৩টি, অপহরণের ঘটনা ঘটেছে ৫৬টি এবং নিখোঁজ হয়েছে ২৭ শিশু। শিশুর নিরাপত্তা, কন্যাশিশুর যৌন হয়রানি থেকে শিশুদের রক্ষাসহ বিভিন্ন বিষয়ে জাতিসংঘ কমিটি উদ্বেগ প্রকাশ করেছিল। এসব বিষয়ে কার্যকর উদ্যোগ না থাকায় কমিটির কাছে জবাবদিহির সময় সরকারকে ‘প্রক্রিয়াধীন’ ও ‘বিবেচনাধীন’ শব্দগুলোই বলতে হয়েছে।
এ বিষয়ে মহিলা ও শিশুবিষয়ক প্রতিমন্ত্রী মেহের আফরোজ চুমকি বলেন, যেসব শিশু ঝুঁকিপূর্ণ কাজ করছে, তাদের পরিবারকে আমরা নিষেধ করলেও শুনবে না। কারণ সংসারে অভাব আছে। আবার এসব শিশুর মা-বাবাকে যদি আইনের আওতায় নিয়ে আসা হয় তবে তাদের ভরণপোষণের দায়িত্ব রাষ্ট্রকে নিতে হবে। সে ক্ষেত্রে রাষ্ট্র এখনও আর্থ-সামাজিকভাবে সেই অবস্থানে যায়নি বলে মন্তব্য