নিজস্ব প্রতিবেদক
নারায়ণগঞ্জের অপহরণোত্তর সাত খুনের ঘটনায় প্রায় আট মাস পর হাইকোর্টে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিয়েছে র্যাব। প্রতিবেদনে মূল অভিযুক্ত হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে সরকারের এক প্রভাবশালী মন্ত্রীর জামাতা লেফটেন্যান্ট কর্নেল তারেক সাঈদ মাহমুদকে। মেজর আরিফ হোসেন ও নৌবাহিনীর লেফটেন্যান্ট কমান্ডার এমএম রানাকেও এ তালিকায় রাখা হয়েছে। এছাড়া র্যাবের আরও ১৮ সদস্য প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে এ ঘটনায় জড়িত ছিলেন বলে উল্লেখ করা হয়েছে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সাতজনকে অপহরণ, খুন ও শীতলক্ষ্যায় লাশ ফেলা পর্যন্ত পুরো ঘটনা সম্পন্ন হয়েছে তারেক ও আরিফের নির্দেশে। তবে র্যাবের বিভাগীয় তদন্ত কমিটির দেওয়া প্রতিবেদনটি পূর্ণাঙ্গ নয় বলে গতকাল জানিয়েছেন হাইকোর্ট। এদিকে আদালত এ ঘটনায় গঠিত সার্বিক তদন্ত কমিটিতে নতুন প্রধান নিয়োগের আদেশও নাকচ করে দিয়েছেন। প্রতিবেদনটি আদালতে পড়ে শোনান অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম। অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম গতকাল সাংবাদিকদের জানান, ঘটনার সময় নারায়ণগঞ্জ র্যাবে থাকা তারেক সাঈদ ও আরিফ সাতজনকে অপহরণোত্তর খুন-গুমের পুরো প্রক্রিয়ায় জড়িত ছিলেন। আর রানা অপহরণে অংশ নিয়ে ঘটনায় আংশিক জড়িত ছিলেন বলে র্যাবের অভ্যন্তরীণ তদন্তে বেরিয়ে এসেছে। প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, ওই তিন পদস্থ কর্মকর্তা ছাড়া আরও ১৮ র্যাব সদস্য সাতজনকে অপহরণ, হত্যা ও লাশ ডোবানোর ঘটনায় সম্পৃক্ত ছিলেন। তবে অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, র্যাবের প্রতিবেদন সাত খুনের মামলার বিচারের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে না। এ বিষয়ে ডিবি যে চার্জশিট দেবে, তার ভিত্তিতেই বিচার হবে। মাহবুবে আলম বলেন, আরও যাদের নাম র্যাবের প্রতিবেদনে এসেছে তারা হলেন- এসআই পূর্ণেন্দু বালা, এবি আরিফ হোসেন, নায়েক নাজিম, নায়েক দেলোয়ার, ল্যান্সনায়েক হিরা মিয়া, সৈনিক মহিউদ্দিন মুন্সী, সৈনিক আবদুল আলিম, সৈনিক আলামিন, সিপাহি তৈয়ব, কনস্টেবল সিহাবুদ্দিন, কনস্টেবল আলামিন, হাবিলদার এমদাদ, ল্যান্সনায়েক বেলাল হোসেন, সৈনিক আসাদ, সার্জেন্ট এনামুল, এএসআই বজলু, হাবিলদার নাসির ও সৈনিক তাজুল। তবে ওই ঘটনার সঙ্গে র্যাব সদর দপ্তরের কোনো সম্পৃক্ততা পাওয়া যায়নি বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। এছাড়া প্রতিবেদন মতে, ব্যবসায়িক স্বার্থ, এলাকায় প্র্রভাব বিস্তার এবং রাজনৈতিক অবস্থানগত প্রতিদ্বন্দ্বিতার কারণে কাউন্সিলর নূর হোসেন অপর কাউন্সিলর নজরুল ইসলামকে অপহরণ ও খুনের পরিকল্পনা করেন। র্যাবের প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, র্যাব সদর দপ্তরকে কোনো কিছু না জানিয়েই অভিযুক্ত কর্মকর্তারা অভিযান চালান এবং সাতজনকে অপহরণ করেন। পরবর্তীকালে তাদের হত্যা করে লাশের সঙ্গে ইট বেঁধে শীতলক্ষ্যায় ডুবিয়ে দেন। লাশ ডুবিয়ে ফেরার পথে র্যাবের দলটির সঙ্গে ঘাটে গিয়ে দেখা করেন র্যাব-১১-এর তৎকালীন অধিনায়ক লে. কর্নেল তারেক সাঈদ। তিনি সংশ্লিষ্ট র্যাব সদস্যদের অভয় দেন, ভবিষ্যতে এ ঘটনায় কোনো কিছু হলে সবকিছু একাই সামাল দেবেন। এ নিয়ে কোনো চিন্তা না করার জন্যও বলেন ওই টিমের সদস্যদের। তদন্তকালে র্যাব-১১তে কর্মরত র্যাব সদস্যের স্যাগ্রহণ, অপহরণোত্তর সাত খুন সংশ্লিষ্ট ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে র্যাবের তদন্ত দল। বিভাগীয় ব্যবস্থা হিসেবে অভিযুক্ত তিন ঊর্ধ্বতন র্যাব কর্মকর্তাকে ফেরত পাঠানো হয় তাদের মাতৃ বাহিনীতে। পরবর্তীকালে পুলিশ ওই কর্মকর্তাদের গ্রেপ্তার করে রিমান্ডে নিলে বেরিয়ে আসে অপহরণোত্তর সাত খুনের আরও অজানা তথ্য। পরে তারা অবশ্য আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়ে ঘটনার জন্য নিজেদের দায় স্বীকার করেন। এদিকে নারায়ণগঞ্জে সাত খুনের ঘটনায় র্যাবের বিভাগীয় তদন্ত কমিটির করা তদন্ত প্রতিবেদন পূর্ণাঙ্গ নয় বলে জানিয়েছেন হাইকোর্ট। এ বিষয়ে আগামী জানুয়ারিতে পরবর্তী শুনানির দিন ধার্য করেছেন আদালত। এছাড়া ঘটনায় গঠিত সার্বিক তদন্ত কমিটিতে নতুন প্রধান নিয়োগের আদেশ নাকচ করে দিয়ে বিচারপতি মো. রেজাউল হক ও বিচারপতি গোবিন্দচন্দ্র ঠাকুরের হাইকোর্ট বেঞ্চ গতকাল এক আদেশে বলেন, শুরু থেকে সাত সদস্যের এ কমিটির প্রধান হিসেবে কাজ চালিয়ে আসা জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব শাহজাহান মোল্লাকেই প্রতিবেদন দিয়ে বাকি দায়িত্ব শেষ করতে হবে। ঘটনায় র্যাব ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীসহ অন্যদের জড়িত থাকার অভিযোগ তদন্তে হাইকোর্টের নির্দেশে গত ৭ মে এ তদন্ত কমিটি গঠন করে সরকার। শাহজাহান মোল্লার নেতৃত্বে সাত সদস্যের কমিটি গত সাত মাসে চার শতাধিক ব্যক্তির স্যা নেয়। তাদের মধ্যে নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের মেয়র সেলিনা হায়াৎ আইভী, এমপি শামীম ওসমান, র্যাবের মহাপরিচালক মোখলেছুর রহমান, অতিরিক্ত মহাপরিচালক কর্নেল জিয়াউল আহসানও রয়েছেন। এরই মধ্যে গত ৯ নভেম্বর শাহজাহান মোল্লাকে বাংলাদেশ সরকারি কর্মকমিশন (পিএসসি) সচিবালয়ের ভারপ্রাপ্ত সচিব হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হলে কমিটির কাজে স্থবিরতা দেখা দেয়। এ কারণে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব মো. আবদুল হাকিমকে গত মঙ্গলবার কমিটির প্রধান হিসেবে নিয়োগ দেয় মন্ত্রণালয়। জানা গেছে, কমিটির কাজ প্রায় শেষ। যে কোনো সময় আদালতে প্রতিবেদন দেবেন তারা। তদন্ত শেষ হয়ে থাকলে এই পর্যায়ে এসে কেন কমিটির নেতৃত্বে পরিবর্তন আনা হচ্ছে- এ প্রশ্ন তুলেই আগের প্রধানকে দায়িত্ব চালিয়ে যেতে বলেছেন হাইকোর্ট। নারায়ণগঞ্জে অপহরণ ও হত্যার ওই ঘটনায় প্রশাসনের কেউ বা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কোনো সদস্যের প্রত্য বা পরো ভূমিকা কিংবা সংশ্লিষ্টতা ছিল কিনা- গণতদন্তের মাধ্যমে তা উদ্ঘাটনের দায়িত্ব দেওয়া হয় কমিটিকে। অপহৃত ব্যক্তিদের জীবিত উদ্ধারে দ্রুত ব্যবস্থা নিতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কোনো অবহেলা বা গাফিলতি ছিল কিনা- কমিটিকে তাও খতিয়ে দেখতে বলেন আদালত। নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের প্যানেল মেয়র নজরুল ইসলামসহ সাতজন গত ২৭ এপ্রিল অপহৃত হন। পরে শীতল্যা নদী থেকে তাদের লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। অপহরণ ঘটনার পর পরই নজরুলের পরিবারের প থেকে সিদ্ধিরগঞ্জ থানা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি নূর হোসেনকে প্রধান আসামি করে একটি মামলা করা হয়। র্যাবকে নূর হোসেন ৬ কোটি টাকা দিয়ে সাতজনকে হত্যা করিয়েছে বলে নজরুলের শ্বশুর শহীদুল ইসলাম অভিযোগ করেন। |
– See more at: http://www.dainikamadershomoy.com/2014/12/11/181577.html#sthash.GCxjQCjV.dpuf