নির্বাচনের বর্ষপূর্তি ৫ জানুয়ারিকে ঘিরে আওয়ামী লীগ-বিএনপির মুখোমুখি অবস্থানে সহিংস সংঘাত, অগি্নসংযোগ এবং ভাংচুরসহ ভয়ংকর নাশকতার আতঙ্কে কাঁপছে গোটা দেশ। উদ্বিগ্ন ব্যবসায়ী, শিল্পপতি এবং চাকরিজীবীসহ বিভিন্ন পেশার মানুষ ইতোমধ্যে দৈনন্দিন কর্মকা-ের রুটিন গুটিয়ে নিয়েছে। সারাদেশের সার্বিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে র্যাব ও পুলিশ রণাঙ্গনের প্রস্তুতি নিলেও শেষ পর্যন্ত আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখা যাবে কিনা, তা নিয়ে খোদ সরকারই চরম শঙ্কায় রয়েছে।
উদ্বেগজনক এই পরিস্থিতিতে ৫ জানুয়ারির আগেই আন্দোলনের কেন্দ্রবিন্দু ঢাকাসহ দেশের গুরুত্বপূর্ণ জেলা শহরগুলোতে ব্যাপক ধরপাকড় শুরু করেছে পুলিশ। যে কোনো সংঘাতময় পরিস্থিতিতে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে তাৎক্ষণিক কঠোর অ্যাকশনে যাওয়ার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। বেসামাল পরিস্থিতিতে সংশ্লিষ্ট এলাকায় ১৪৪ ধারা জারি করার সিদ্ধান্ত রয়েছে।
পুলিশ সদর দপ্তরের একটি সূত্র জানায়, ৫ জানুয়ারি ভোর থেকে সারাদেশে র্যাব, পুলিশ এবং আনসারসহ আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ৮০ হাজার সদস্য রণসাজে মাঠে নামবে। ঢাকাসহ গুরুত্বপূর্ণ জেলাগুলোতে বিপুল সংখ্যক বিজিবি নামানো হবে। এছাড়া তাদের আরো একটি বড় অংশ ‘স্ট্যান্ডবাই’ থাকবে, যাতে যে কোনো জরুরি মুহূর্তে তাৎক্ষণিকভাবে তাদের মাঠে নামানো যায়। বিএনপি-জামায়াত অধ্যুষিত স্পর্শকাতর জেলাগুলোতে কয়েকদিন আগে থেকে গোয়েন্দা নজরদারি বাড়ানো হয়েছে।
প্রশাসনের শীর্ষ পর্যায়ের নির্দেশে বুধবার থেকে দেশের প্রতিটি জেলার ডিসি-এসপি আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণের দায়িত্ব পালন করছেন। সন্দেহভাজন বোমাবাজ এবং অস্ত্রধারী পলিটিক্যাল ক্যাডারসহ ভাড়াটে পিকেটারদের গ্রেপ্তারের বিষয়টিও পুলিশের স্থানীয় পর্যায়ের শীর্ষ কর্মকর্তাদের তদারকিতে রয়েছে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে পুলিশ সদর দপ্তরের একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা জানান, গত বৃহস্পতিবার থেকেই সন্দেহভাজন তা-বকারীদের গ্রেপ্তার অভিযান চলছে। শনিবার মধ্যরাত থেকে তা আরো জোরদার হচ্ছে। কোনো বিশেষ দলকে টার্গেট করে নয়, শুধু ৫ জানুয়ারির সাংঘর্ষিক পরিস্থিতি মোকাবেলায় এই উদ্যোগ নেয়া হয়েছে বলে দাবি করেন ওই পুলিশ কর্মকর্তা।
তবে বিএনপি-জামায়াতের শীর্ষ নেতাদের অভিযোগ, আন্দোলন দমাতে সরকার বেছে বেছে তাদের নেতাকর্মীদের গ্রেপ্তার করছে। তাদের বিভিন্ন মিথ্যা মামলায় ফাঁসানো হচ্ছে।
তাদের এই দাবি যে অবান্তর নয়, তা গত কয়েকদিনের ধরপাকড়ের তালিকা পর্যবেক্ষণে নিশ্চিত হওয়া গেছে। আমাদের বিভিন্ন জেলা প্রতিনিধির পাঠানো তথ্য পর্যালোচনায় দেখা গেছে, গ্রেপ্তারকৃতদের অধিকাংশই বিএনপি-জামায়াতের নেতাকর্মী।
এদিকে, শুক্রবার রাত থেকে শনিবার ভোর পর্যন্ত যশোরের বিভিন্ন স্থানে অভিযান চালিয়ে অর্ধশতাধিক নেতাকর্র্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। জেলা পুলিশের মুখপাত্র সহকারী পুলিশ সুপার রেশমা শারমিন এ খবর নিশ্চিত করেছেন। তবে তার দাবি, আটকদের মধ্যে ৬ জন রাজনৈতিক কর্মী। বাকিরা বিভিন্ন মামলার আসামি। যদিও যশোর জেলা বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক দেলোয়ার হোসেন খোকন জানিয়েছেন, গ্রেপ্তারকৃতদের অধিকাংশই বিএনপিকর্মী।
এদিকে, গত ২৪ ঘণ্টায় বগুড়ায় ৭৯ জনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। জেলা পুলিশের মিডিয়া সেলের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা বগুড়ার সহকারী পুলিশ সুপার (সদর) গাজিউর রহমান এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন।
তিনি জানান, বিশেষ অভিযানের অংশ হিসেবে শুক্রবার ভোর ৬টা থেকে শনিবার ভোর ৬টা পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টায় জেলার ১২টি উপজেলায় অভিযান চালিয়ে ওয়ারেন্টভুক্ত এবং নিয়মিত মামলার আসামি হিসেবে বিএনপি-জামায়াতের ১১ নেতাকর্মীসহ ৭৯ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
এছাড়া চট্টগ্রাম, পিরোজপুর, গাইবান্ধা, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, রংপুর, মৌলভীবাজার, ঠাকুরগাঁও, সাতক্ষীরা, দিনাজপুর, নীলফামারী, জয়পুরহাট, সিরাজগঞ্জ, ঝিনাইদহ, পাবনা, গাজীপুর এবং নোয়াখালীসহ বিএনপি-জামায়াত অধ্যুষিত ৩১টি জেলা থেকে আরো দেড় সহস্রাধিক ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে বলে জানা গেছে।
এদিকে, ৫ জানুয়ারিকে ঘিরে বিএনপি-আওয়ামী লীগের মুখোমুখি অবস্থানে উদ্ভূত যে কোনো সহিংস পরিস্থিতি মোকাবেলায় রাজধানীতে সোয়াত, বোম ডিস্পোজাল টিম, আর্মড পুলিশ এবং দাঙ্গা বাহিনীসহ প্রায় ১০ হাজার ফোর্স নামানো হচ্ছে। মহানগরীর গুরুত্বপূর্ণ প্রতিটি পয়েন্টে এপিসি, জলকামান এবং রায়টকার প্রস্তুত রাখা হবে। স্পর্শকাতর জেলার প্রবেশমুখসহ দেশের ৭টি মহানগরীর ব্যস্ততম সড়কে বসছে বিশেষ চেকপোস্ট। গত বছর ২ জানুয়ারির সংঘাতময় পরিস্থিতি বিবেচনায় রেখে নিরাপত্তাব্যবস্থার এই ছক তৈরি করা হয়েছে বলে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে।
পুলিশ সদর দপ্তরের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জানান, জামায়াত-শিবিরের বিভিন্ন ধরনের তা-বের প্রস্তুতির আগাম তথ্য তাদের হাতে এসেছে। তাই যেখানে তাদের শক্ত ঘাঁটি রয়েছে, সেখানেই সর্বোচ্চ নিরাপত্তাব্যবস্থা নিশ্চিত করতে জেলার পুলিশ সুপারদের নির্দেশ দেয়া হয়েছে। জামায়াত-শিবিরের নেতাকর্মীদের পাশাপাশি তাদের সঙ্গে সম্পৃক্ত বিভিন্ন মৌলবাদী জঙ্গি সংগঠনের গতিবিধিও নজরদারিতে রাখা হচ্ছে।
ডিএমপি সূত্র জানায়, রোববার ভোর থেকে গাবতলী, সায়েদাবাদ, মহাখালী, সদরঘাট, কমলাপুর, বিজয় সরণি, ফার্মগেট, সাতরাস্তা, মগবাজার, নয়া পল্টন, কাকরাইল, শাহবাগ, আরামবাগ, মালিবাগ, শাহজাহানপুর, প্রেসক্লাব, বিজয়নগর, বায়তুল মোকাররম উত্তর ও দক্ষিণ গেট এবং দৈনিক বাংলা মোড়সহ বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ স্থানে অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন করা হবে। সোমবার ভোরে এর কয়েকটি পয়েন্টে এপিসি, জলকামান এবং রায়টকারসহ পুলিশের বিশেষ গাড়িটহল যোগ দেবে।
রাজধানীর নিরাপত্তায় সর্বোচ্চ প্রস্তুতি নেয়া হয়েছে দাবি করে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) উপ-কমিশনার (মিডিয়া) মাসুদুর রহমান বলেন, নাগরিকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য যা যা করণীয়, তার সবই করা হচ্ছে। যে কোনো অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতি যেন দ্রুত সামাল দেয়া যায়, সেজন্য বিশেষ ফোর্স স্ট্যান্ডবাই রাখা হচ্ছে।
দেশের বিভিন্ন জেলার নিরাপত্তাব্যবস্থা জোরদারের বিষয়টি নিশ্চিত করে একাধিক পুলিশ সুপার যায়যায়দিনকে জানান, সদর দপ্তরের নির্দেশনা অনুযায়ী গুরুত্বপূর্ণ এলাকায় অতিরিক্ত ফোর্স মোতায়েন করা হয়েছে। বাড়ানো হয়েছে কার ও ফুট পেট্রল। পাশাপাশি বৃহস্পতিবার থেকেই গোয়েন্দা নজরদারি এবং চেকপোস্ট বসিয়ে তল্লাশি শুরু করা হয়েছে।
এদিকে, র্যাব-পুলিশের এই সাজ সাজ প্রস্তুতিতেও শেষ রক্ষা হবে কিনা, তা নিয়ে জনমনে শঙ্কা ক্রমেই বাড়ছে। বিশেষ করে যারা বিএনপি-জামায়াত এবং আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের গতিবিধি পর্যালোচনা করছেন, তাদের মধ্যে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার পারদ সর্বোচ্চ সীমায় গিয়ে ঠেকেছে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে মিরপুর এলাকার একজন গার্মেন্ট ব্যবসায়ী জানান, ৫ জানুয়ারির কর্মসূচি উপলক্ষে বিএনপি এবং আওয়ামী লীগ_ উভয় দলের নেতাকর্মীরাই তার কাছ থেকে মোটা অঙ্কের চাঁদা নিয়ে গেছেন। তারা দু’পক্ষই ওইদিন দিনভর রাজপথ দখল করে আক্রমণ-পাল্টা আক্রমণে থাকবেন বলে জানিয়েছেন। উদ্বেগজনক এই পরিস্থিতিতে তিনি সোমবার কারখানা বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।
এদিকে, ৫ জানুয়ারি ঢাকায় জনসভা করার ব্যাপারে পুলিশের পক্ষ থেকে সাড়া না পাওয়ায় বিএনপি নেতারা বলছেন, ওইদিন তারা ‘যে কোনো মূল্যে’ সভা করবেন।
একই দিন ঢাকার ১৬টি স্থানে ‘গণতন্ত্রের বিজয়ে সমাবেশ’ সফল করার ব্যাপারে নিশ্চিত আওয়ামী লীগ।
ক্ষমতাসীন দলটির নেতারা বলছেন, বিএনপির যে কোনো ‘অশুভ তৎপরতা’ তারা মোকাবেলা করবেন। এজন্য তাদের সব ধরনের প্রস্তুতি রয়েছে। তাদের এই হুঙ্কার যে অহেতুক নয়, মাঠ পর্যায়ের আওয়ামী লীগ নেতাদের সঙ্গে কথা বলে তা নিশ্চিত হওয়া গেছে। রাজধানীর ওয়ার্ড এবং থানা পর্যায়ের নেতাকর্মীরা শুক্রবার থেকেই তাদের শক্তি প্রদর্শনের নানা মহড়ায় ব্যস্ত রয়েছেন।
বিএনপি-জামায়াতের নেতাকর্মীদেরও একই ধরনের প্রস্তুতি নেয়ার খবর পাওয়া গেছে। তবে ক্ষমতার বাইরে থাকায় তাদের এই শোডাউন অনেকটা গোপনে চলছে বলে দলের নেতারা স্বীকার করেছেন।
বিএনপির প্রথম সারির একজন নেতা ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, গত কয়েকদিন ধরেই নানা অজুহাতে তাদের নেতাকর্মীদের গ্রেপ্তার করা হচ্ছে। আতঙ্কিত কর্মীরা কেউ বাসা-বাড়িতে ঘুমাতে পারছে না। অনেকেই এলাকা ছেড়ে দূরে আত্মীয়-স্বজনের বাসায় আশ্রয় নিয়েছে। এ পরিস্থিতিতে ৫ জানুয়ারির কর্মসূচি তারা কতটা সফল করতে পারবে, তা নিয়ে নিজেরাই সন্দিহান হয়ে পড়েছেন। –