দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে আন্তর্জাতিক মধ্যস্থতার দাবির সমালোচনা করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, নিজেদের সমস্যার সমাধান করার সামর্থ্য বাংলাদেশের রয়েছে।
শনিবার আন্তর্জাতিক ভাষা দিবস উপলক্ষে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউটে এক আলোচনা সভায় তিনি এ কথা বলেন।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, “যখন বাংলাদেশ বিশ্বের কাছে উন্নয়নের রোল মডেল, ঠিক সেইসময় এমন অবস্থা সৃষ্টি করতে হল যে অন্যের কাছ থেকে যেন পরামর্শ চেয়ে আনার চেষ্টা। কেন? আমাদের সমস্যাতো আমরাই সমাধান করতে পারি।”
বিএনপি জোটের লাগাতার অবরোধ-হরতালের মধ্যে সহিংসতার প্রেক্ষাপটে সুশীল সমাজের একটি অংশ আন্তর্জাতিক মধ্যস্থতা চেয়ে বক্তৃতা, বিবৃতি দিয়ে আসছে। এরই মধ্যে জোটের এই কর্মসূচির মধ্যে পেট্রোল বোমা সহিংসতা ছাড়াও হামলায় প্রাণ হারিয়েছেন ৬০ জনের বেশি।
আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোও এ বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে; তারা বলছে, সংলাপের মাধ্যমে বর্তমান অবস্থা থেকে উত্তরণের পথ বের করতে হবে।
যদিও মানুষ হত্যাকারীদের সঙ্গে সংলাপে বসার কথা নাকচ করে দিয়েছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। সহিংসতার পথ পরিহার করলেই কেবল সংলাপের বিষয় ভেবে দেখা হবে বলে দলটির শীর্ষ নেতারা বলে আসছেন।
আলোচনা সভায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিএনপি জোটের সহিংসতাকে ‘বাঙালির অস্তিত্বের ওপর আঘাত’ আখ্যায়িত করে তা মোকাবেলায় ‘প্রতিঘাত’ করার আহ্বান জানান।
তিনি বলেন, “সবচেয়ে দুর্ভাগ্য মানুষকে আগুন দিয়ে পুড়িয়ে মারা; এর থেকে জঘন্য কাজ আর কিছু হয় না। বিএনপি ও জামায়াত মিলে তারা এই কাজটা করে যাচ্ছে।
“এই হত্যা, এটা সাধারণ হত্যা না। এটা স্বাধীনতার ওপর আঘাত, ভাষার ওপর আঘাত, অস্তিত্বের ওপর আঘাত। বাঙালি জাতির ওপর আঘাত। কাজেই এই আঘাত আমাদেরকে প্রতিঘাত দিয়ে তুলে দিতে হবে। এবং আমাদেরকে এগিয়ে যেতে হবে; মাথা উঁচু করে বিশ্ব দরবারে যেন আমরা চলতে পারি।”
অবরোধ-হরতালে পেট্রোল বোমা মেরে মানুষ হত্যার নিন্দা জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, “যে বাঙালি তার মাতৃভাষার জন্য জীবন দেয়, স্বাধীনতার জন্য জীবন দেয়, নিজের মর্যাদার জন্য আত্মত্যাগ করে; সেই বাঙালিকেই পুড়িয়ে মারে এদেশের মানুষ।
“আমি জানি না কার বিরুদ্ধে প্রতিশোধ নিচ্ছে? তাহলে কি বাংলাদেশ যে স্বাধীন হয়েছে এটা তাদের পছন্দ না? বা বাংলা ভাষা এটাও কি পছন্দ না? বাংলা আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস বা শহীদ দিবস এটাও কি পছন্দ না?”
বিএনপি জোটের প্রতি ইঙ্গিত করে বলেন, “বাঙালি জাতি আজকে বিশ্বসভায় যে মর্যাদা পেয়েছে সেই মর্যাদাই বোধ হয় এই গোষ্ঠী ধরে রাখতে চায় না।”
“তবে বাঙালি যেহেতু কখনো কারো কাছে পরাজয় স্বীকার করে নাই, পরাভব মানে নাই। যেকোন প্রতিকূল অবস্থা মোকাবিলা করে এগিয়ে যাওয়ার ইতিহাস আমাদের রয়েছে। সেই ইতিহাস আমাদেরকে শিক্ষা দেবে এই অবস্থা থেকে উত্তরণ ঘটিয়ে আমরা আগামী দিনে কিভাবে এগিয়ে যাবো এবং আমরা তা পারবো ইনশাল্লাহ।”
আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসে শহীদ মিনারে ফুল দিতে না যাওয়ায় খালেদা জিয়ার দিকে ইঙ্গিত করে তিনি বলেন, “একুশে ফেব্রুয়ারি এমন একটি দিবস আমাদের জীবনে; দলমত নির্বিশেষে সকল স্তরের মানুষ সারা বাংলাদেশেই এমনকি যারা প্রবাসে থাকে তারাও কিন্তু এ দিবসটিকে অত্যন্ত মর্জাদার সাথে পালন করে থাকে। এ এক অভূতপূর্ব চেতনা। অনেকের হয়তো ভালো লাগে না। অনেকেই হয়তো শহীদ মিনারে যান না বা যেতে চান না। কিন্তু বাঙালি জাতি হিসেবে যারা নিজের মর্জাদা সম্পর্কে সচেতন সকলেই কিন্তু এ দিবসটিকে স্মরণ করে।”
শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদের সভাপতিত্বে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের আলোচনাসভায় মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন লেখিকা সেলিনা হোসেন।
‘ভাষা আন্দোলন থেকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস: নারীর প্রজ্ঞা’ শীর্ষক প্রবন্ধে সেলিনা হোসেন বাংলাদেশ ও ইউনেস্কোর যৌথ উদ্যোগে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউটের পক্ষ থেকে ভাষা ও সাহিত্যে একটি আন্তর্জাতিক পুরস্কার প্রবর্তনের সুপারিশ করেন।
এ বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, “এখনো ইউনেস্কোর সঙ্গে ওইভাবে আলোচনা হয়নি। বরং আমরা ‘ভাষা ও সাহিত্য আন্তর্জাতিক পুরস্কার’ নামে একটা পুরস্কার এই ইনস্টিটিউট থেকে প্রবর্তন করতে পারি।
“আমি আশা করি এ ব্যাপারে এ প্রতিষ্ঠান থেকে খুব দ্রুত একটা পদক্ষেপ নেওয়া হবে এবং এর জন্য হয়ত প্রাথমিকভাবে কিছু অর্থ আমাদের সংগ্রহ করতে হবে। আমি মনে করি বাংলাদেশ অর্থের দিক দিয়ে এখন অত দুর্বল না। কাজেই এটুকু আমরা করতে পারব।”
এসময় শেখ হাসিনা ১৯৯৯ সালে ইউনেস্কো কর্তৃক ২১ ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস ঘোষণার পেছনে সেই সময় তার নেতৃত্বাধীন সরকারের ভূমিকার কথা তুলে ধরেন।
এ অর্জনকে ধরে রাখার জন্যই বিভিন্ন ভাষার ওপর গবেষণা ও ভাষা সংরক্ষণের জন্য তার সরকার আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠা করেছে বলেও জানান তিনি।
শেখ হাসিনা বলেন, “আজকে আমাদের ওপর দায়িত্ব সারা বিশ্বের সকল মানুষের মাতৃভাষার মর্যাদা রক্ষা করা এবং ভাষা সংরক্ষণ করা। ভাষার ওপর গবেষণা করা। কিন্তু আমাদের সেই দায়িত্বটা যথাযথভাবে পালন করতে হবে।”
বাংলা ভাষাকে জাতিসংঘের দাপ্তরিক ভাষা করার বিষয়েও প্রচেষ্টা চলছে বলে জানা তিনি।
–