সাভারে রানা প্লাজা ধসের দুই বছর পরও আহত শ্রমিকদের ৫৫ শতাংশ কাজে ফিরতে পারেননি। সে কারণে তাঁদের ৫৪ শতাংশ শ্রমিক দৈনন্দিন চাহিদা মেটাতে হিমশিম খাচ্ছেন।
এই শ্রমিকদের কাজে যোগ দিতে না পারার বড় কারণ শারীরিক সমস্যা। ৬৯ শতাংশ শ্রমিকই নানা শারীরিক সমস্যায় ভুগছেন। ১৫ শতাংশ শ্রমিক পছন্দসই কাজ পাচ্ছেন না। ৭ শতাংশ শ্রমিককে এখনো রানা প্লাজার আতঙ্ক তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে।
রানা প্লাজা ধসে আহত এবং নিহত শ্রমিক পরিবারের ২ হাজার ২০০ জনের ওপর জরিপ চালিয়ে এমন চিত্রই পেয়েছে আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থা অ্যাকশনএইড বাংলাদেশ। রাজধানীর ব্র্যাক সেন্টার ইনে গতকাল বুধবার জরিপটি প্রকাশ করা হয়।
জরিপটি করার জন্য ১ হাজার ৪১৪ জন আহত শ্রমিক এবং নিহত শ্রমিকদের পরিবারের ৭৮৬ জনের সঙ্গে কথা বলেছে অ্যাকশনএইড। এই কাজটি হয়েছে এ বছরের ১৩ থেকে ২৫ মার্চ।
এবারের জরিপে রানা প্লাজার ঘটনায় ন্যায়বিচারের বিষয়টিকেও সামনে আনা হয়েছে। জরিপে অংশ নেওয়া ব্যক্তিদের মধ্যে ২৮৬ জন রানা প্লাজার মালিক এবং ২৫০ জন কারখানা মালিকের শাস্তি দাবি করেছেন। কিন্তু এ ঘটনায় দায়ের করা মামলায় এখনো পর্যন্ত চার্জশিট দিতে পারেনি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী।
এ প্রসঙ্গে অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি শ্রম মন্ত্রণালয়সংক্রান্ত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি ইস্রাফিল আলম বলেছেন, ‘বিচারিক ব্যবস্থা খুবই হতাশাজনক অবস্থায় আছে। শ্রম আইনে আমরা নয়টি মামলা করেছি। সেগুলোর অগ্রগতি নেই।…যাঁদের অবহেলার কারণে এ ঘটনা (রানা প্লাজা ধস) ঘটেছে, তাঁরা কিন্তু খুবই প্রভাবশালী। আমার আশঙ্কা, ক্ষতিগ্রস্তরা হয়তো শেষ পর্যন্ত বিচার পাবেন না।’
অনুষ্ঠানে অ্যাকশনএইডের জরিপটি উপস্থাপন করেন সংস্থার উপপরিচালক আমানুর রহমান। জরিপে উঠে এসেছে, আহত শ্রমিকদের ৭০ দশমিক ৬ শতাংশ মনে করেন, তাঁদের শারীরিক অবস্থা অনেকটা ভালো হয়েছে। তবে ২২ দশমিক ৬ শতাংশ বলেছেন, তাঁদের অবস্থা আগের চেয়ে খারাপ হয়েছে। ১ দশমিক ৫ শতাংশ মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকিতে আছেন। ৬১ দশমিক ২ শতাংশ শ্রমিককে এখনো চিকিৎসকের কাছে যেতে হয়। প্রতি মাসে গড়ে একজন শ্রমিককে চিকিৎসার জন্য ব্যয় করতে হচ্ছে ১ হাজার ৬০০ টাকা।
ক্ষতিগ্রস্ত শ্রমিকদের মানসিক অবস্থা এখনো স্বাভাবিক হয়নি। ৫৯ শতাংশ শ্রমিকের আতঙ্ক ও হতাশা রয়েছে। ৬ দশমিক ৬ শতাংশ শ্রমিক পুরোপুরি সেরে গেছেন।
জরিপ বলছে, আহত শ্রমিকদের ৪৪ শতাংশ বিভিন্ন ধরনের কাজ করছেন। এ শ্রমিকদের ৩৫ শতাংশ পোশাক কারখানায়, ১৬ শতাংশ দর্জির কাজ, ১৪ শতাংশ দিনমজুর ও ১১ শতাংশ খণ্ডকালীন কাজ করছেন। জরিপে অংশ নেওয়া ১ হাজার ৭৬ শ্রমিক (৭৬ শতাংশ) মাসে ৫ হাজার ৩০০ টাকা আয় করেন। ৭ হাজার ৩০০ টাকা পর্যন্ত আয় করেন ১১ শতাংশ শ্রমিক।
অ্যাকশনএইডের জরিপে অংশ নেওয়া শ্রমিকদের আয়ের ওপর নির্ভরশীল ব্যক্তির সংখ্যা এক থেকে পাঁচ। জরিপ বলছে, ২৯ শতাংশ শ্রমিক এখন পরিবারের সদস্যদের ভরণপোষণ করতে পারছেন না। ২ শতাংশ শ্রমিক জীবিকা নির্বাহ করতে পারছেন না।
অনুষ্ঠানে পোশাকশিল্প মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএর সহসভাপতি শহিদ উল্লাহ আজিম বলেন, ‘রানা প্লাজায় হতাহত শ্রমিকদের ৪৫ জন বাচ্চার লেখাপড়া ও ভরণপোষণের দায়িত্ব বিজিএমইএ নিয়েছে। অনেক কারখানা মালিক ১০০ বাচ্চার দায়িত্বও নিতে চান। কিন্তু আমরা বাচ্চা পাচ্ছি না।’
আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) কর্মসূচি ব্যবস্থাপক তুমো পুতিয়ানিন বলেন, ‘রানা প্লাজার মতো ঘটনা যেন আর না ঘটে, সে জন্য আমরা দুই বছর ধরে কাজ করছি। তবে আরও অনেক কিছু করার আছে।’
ক্ষতিপূরণ প্রসঙ্গ: জরিপ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিলে ১২৭ কোটি টাকা থাকলেও তা থেকে ৯ এপ্রিল পর্যন্ত ব্যয় হয়েছে ২২ কোটি ৯৩ লাখ টাকা। রানা প্লাজা ডোনারস ট্রাস্ট ফান্ডে ৩ কোটি ডলার জমা পড়ার কথা ছিল। কিন্তু জমা হয়েছে দুই কোটি ১৫ লাখ ডলার। প্রতিশ্রুতি দেওয়ার পরও অনেক বড় ব্র্যান্ড প্রতিষ্ঠান এখনো ৮৫ লাখ ডলার এ তহবিলে জমা দেয়নি। জরিপ বলছে, ৫৩ শতাংশ শ্রমিক এখনো ন্যায্য ক্ষতিপূরণ চান।
ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের মধ্যে যাঁরা বাদ পড়েছেন, তাঁদের দ্রুত ক্ষতিপূরণের জন্য আবেদন করার আহ্বান জানান রানা প্লাজা সমন্বয় কমিটির নির্বাহী পরিচালক মুজতাবা কাজাজি। কারণ তাঁদের সাভারের কার্যালয় শিগগিরই বন্ধ করে দেওয়া হবে। তিনি জানান, তাঁরা তিন দফায় হতাহত শ্রমিকদের ৭৬ কোটি টাকার ক্ষতিপূরণ দিয়েছেন।
ক্ষতিপূরণ প্রসঙ্গে সাংসদ ইস্রাফিল আলম বলেন, ক্ষতিপূরণ নিয়ে দেশে একধরনের বিতর্ক তৈরি হয়েছে। কোন পদ্ধতিতে হতাহত ব্যক্তিদের ক্ষতিপূরণ দেওয়া হবে, সেটা যতক্ষণ ঠিক না হবে, ততক্ষণ এই বিতর্ক চলবেই।
অ্যাকশনএইডের এদেশীয় পরিচালক ফারাহ কবিরের সঞ্চালনায় অনুষ্ঠানে কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তরের মহাপরিদর্শক সৈয়দ আহমদ, সিপিডির গবেষণা প্রধান খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম প্রমুখ বক্তব্য দেন।