নিজস্ব প্রতিবেদকঃ কক্সবাজারের উখিয়ার জালিয়াপালং ইউনিয়নের বিভিন্ন উপকুলীয় এলাকার তিন শতাধিক মানব পাচারকারীকে আটক করতে সাড়াশি অভিযান শুরু করেছে পুলিশ প্রশাসন ও আইন শৃংখলা বাহিনী। গত শনিবার রাত ২টার দিকে উপকুলের শীর্ষ মানব পাচারকারী জাফর আলম ওরফে- জাফর মাঝি ডিবি পুলিশের সাথে বন্দুক যুদ্ধের ঘটনায় নিহত হওয়ার পরপরই থানা পুলিশ মানবপাচারকারী শীর্ষ দালালদের আটকে অভিযানে নেমেছে। গত রবিবার রাতে পুলিশ, ব্যাটেলিয়ান আনসার ও গোয়েন্দা সংস্থা লোকজন সহ প্রায় অর্ধ শতাধিক আইন প্রয়োগকারী সংস্থা উপজেলার বিভিন্ন স্পর্শকাতর এলাকায় ব্যাপক তলাশী অভিযান শেষে সাংবাদিকদের জানান, গ্রেফতার এড়াতে দালাল চক্র আত্মগোপন করেছে।সূত্রমতে, ২০০৮ সাল থেকে মালয়েশিয়ায় মানব পাচার শুরু হলেও তা ছিল চোখে পড়ার মত নয়। ২০১২ সাল থেকে উপকুলের বিভিন্ন পয়েন্ট দিয়ে সাগরপথে মানব পাচারের জমজমাট আয়োজন চলতে থাকে। পুঁজিবিহীন এ ব্যবসায় অতি লাভের নেশায় দালালের সংখ্যা দিন দিন বৃদ্ধি পেতে থাকে।দালালের ভাষ্যমতে, ঘাট থেকে একটি মাথা নৌকায় তুলে দিলে বিনিময়ে পাচ্ছে ২০ হাজার টাকা। এ টাকার লোভে সংঘবদ্ধ দালাল চক্র ছাত্র, কিশোর, যুবক এমনকি সাগর উপকুলে পোনা ধরে জীবিকা নির্বাহ করে আসছে এমন উপজাতি নিরীহ লোকজনদের অপহরণ করে ফিশিং বোটে তুলে দেওয়ার মত একাধিক বিরল ঘটনা ঘটেছে উখিয়ার ৩০ কিলোমিটার সাগর উপকুলীয় এলাকায়।গতকাল সোমবার সকালে পালংখালী ইউনিয়নের তেলখোলা গ্রাম ঘুরে স্থানীয় গ্রামবাসীর সাথে কথা বলে জানা যায়, ওই গ্রামের চৈপুচিং চাকমার ছেলে øেহ কুমার (১৮), কেউচিমং এর ছেলে ছপাইংগ্যা (১৬), পাংচিমং এর ছেলে কিনডু চাকমা (১৪) ও মংচাইমং এর ছেলে মংতেছ (১৯) সহ এ ৫ জন প্রতিদিনের মত ২০১৪ সালের ৫ সেপ্টেম্বর সকালে মনখালী উপকুলীয় এলাকায় পোনা ধরতে গেলে স্থানীয় পাচারকারীরা তাদের জোর করে নৌকায় তুলে দেয়। পরে সাগরের গভীরে অপেক্ষমান ট্রলারে ৫ উপজাতিকে তুলে দিলে তারা মালয়েশিয়ার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলেও পথিমধ্যে নিখোঁজ হয়ে যায়। বয়োবৃদ্ধ ছৈপুচিং চাকমা জানায়, তারা বর্তমানে থাইল্যান্ডের পুলচোয়ান কারাগারে বন্দী জীবনযাপন করছে বলে জানতে পেরেছি। পরিবারের সামর্থ্য না থাকায় তাদের উদ্ধারের ব্যাপারে পরিবার এগুতে পারছে না। ছৈপুচিং চাকমা আরো জানায়, এ ব্যাপারে মানব পাচারের উপর কর্মরত স্থানীয় এনজিও সংস্থা হেলপ্ কক্সবাজার কর্তৃপক্ষের বরাবরে একটি অভিযোগ করা হয়েছে। হেলপ্ কক্সবাজারের নির্বাহী পরিচালক এমএ কাশেম জানান, তাদের উদ্ধারের ব্যাপারে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে আবেদন করা হয়েছে।একইভাবে এনজিও সংস্থার কাযালয়ে অভিযোগ করতে আসা জালিয়াপালং ইউনিয়নের উপকুলীয় এলাকার বাসিন্দা উত্তর সোনাইছড়ি গ্রামের হাজেরা খাতুন (৪৫) জানান, তার ১৩ বছরের শিশু সন্তান এনামুল হককে অপহরণ করে মালয়েশিয়ায় পাচার করে দেওয়া হয়েছে। প্রায় ৫ মাস অতিবাহিত হলেও ছেলের কোন খোঁজখবর পাওয়া যায়নি। একইভাবে জালিয়াপালং ইউনিয়নের দীঘিরবিল গ্রামের হতদরিদ্র পরিবার রাজা মিয়া জানান, তার একমাত্র ছেলে খোরশেদ আলম ২০১৪ সালের ডিসেম্বরে উপকুলীয় এলাকা থেকে অপহৃত হয়। স্থানীয়রা বলছে, তাকে মালয়েশিয়া পাঠিয়ে দিয়েছে দালালেরা। বড় ইনানী গ্রামের আবুল মনসুর জানান, ডেইলপাড়া গ্রামের শামশু প্রকাশ লেইঙ্গার ছেলে দালাল শামশু আড়াই লক্ষ টাকার চুক্তিতে ৩০ হাজার টাকা নগদ প্রদান করে তার ছেলে ইমরান (১৫) কে মালয়েশিয়া পাঠানোর নামে সাগর পথে পাচার করে দেয়। এ পর্যন্তও ছেলের কোন খোঁজখবর পাওয়া যায়নি। এভাবে উপকুলীয় এলাকার মনখালী, চোয়াংখালী, ছেপটখালী, মাদারবনিয়া, রূপপতি, ইনানী, সোনাইছড়ি, জুম্মাপাড়া এলাকার প্রায় ৩ শতাধিক কিশোর,যুবক, ছাত্র নিখোঁজ হয়ে গেছে। অস্বচ্ছল এ পরিবারগুলো তাদের স্বজনদের উদ্ধারের থানা বা আদালতের দ্বারস্থ পর্যন্ত হতে পারেনি।জালিয়াপালং ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আনোয়ার হোসেন চৌধুরী জানান, ভদ্রতার মুখোশ পড়ে এক শ্রেণির তথাকথিত জনপ্রতিনিধি, রাজনৈতিক নেতা সহ গ্রামভিত্তিক সর্দার শ্রেণির অসাধু ব্যক্তি মানব পাচারে জড়িত থাকার কারণে উপকুলীয় এলাকা দিয়ে ঢালাওভাবে মানব পাচার হতে পেরেছে। এদের গ্রেফতার করা না হলে মানব পাচার বন্ধ করা সম্ভব হবে না। জালিয়াপালং ইউনিয়ন কমিউনিটি পুলিশের সভাপতি শহীদুলাহ কায়ছার অভিযোগ করে জানান, জালিয়াপালং ইউনিয়নের উপকুলীয় এলাকায় ঘরে ঘরে দালাল রয়েছে। এসব দালালেরা মাত্র ২০ হাজার টাকার লোভে যে কোন বয়সের লোকজনকে জোর করে নৌকায় তুলে দিয়েছে। এক মাথা নৌকায় তুলে দিতে পারলে ২০ হাজার টাকা আয়ের লোভে দিন দিন দালালের সংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় সাগর পথে পাচার হয়েছে অসংখ্য মানুষ। এনজিও সংস্থা হেলপ কক্সবাজারের নির্বাহী পরিচালক আবুল কাশেম এমএ জানান, গত ৩ বছরে উপকুলের বিভিন্ন পয়েন্ট দিয়ে মালয়েশিয়ার উদ্দেশ্যে সাগরপথে পাচার হয়েছে জেলার ৫০ হাজার মানুষ। তৎমধ্যে এ পর্যন্তও নিখোজ রয়েছে প্রায় সাড়ে তিন হাজার।তিনি আরো বলেন, মানব পাচারের উপর কর্মরত আমেরিকা ভিত্তিক এনজিও সংস্থা রিলিফ ইন্টারন্যাশনালের সহযোগীতায় তারা ক্ষতিগ্রস্থ ৩০টি পরিবারের মধ্যে ১০ হাজার টাকা করে অনুদান দিয়েছেন এবং থাইল্যান্ডের বিভিন্ন কারাগারে আটক থাকা লোকজনদের উদ্ধারের ব্যাপারে কাজ করছে। উখিয়া থানার অফিসার ইনচার্জ জহিরুল ইসলাম খান জানান, ২০১২ সাল থেকে এ পর্যন্ত থানায় ৪৫টি মানব পাচার প্রতিরোধ আইনে মামলা হয়েছে। এসব মামলায় আসামী করা হয়েছে ৩ শতাধিক পাচারকারীর বিরুদ্ধে। এসব পাচারকারীর মধ্যে শীর্ষ মানব পাচারকারীর ২৫ জনকে গ্রেফতার করে আদালতে প্রেরণ করা হয়েছে। তিনি বলেন, এসব পাচারকারীদের আইনের আওতায় আনার লক্ষ্যে পুলিশ উপজেলাব্যাপী সাড়াশি অভিযান শুরু করেছে।