ব্যবসায়ীকে অপহরণ করে একটি ঘরে শেকল দিয়ে বেঁধে রাখা হয়েছিল। মুক্তিপণ হিসেবে ৩০ হাজার টাকা দেওয়ার পরও ছাড়ছিল না অপহরণকারীরা। পরে র্যাবের অভিযানে উদ্ধার করা হয় ব্যবসায়ীকে। আটক করা হয় জিম্মিশালার এক ‘পাহারাদার’কে।
এই অপহরণ বাণিজ্যের মূল হোতা হিসেবে উঠে এসেছে ঢাকা জেলা গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) এক কর্মকর্তার নাম। ঘটনা জানাজানির পর ঢাকা জেলা পুলিশ ওই কর্মকর্তাকে প্রত্যাহার করেছে।
ওই কর্মকর্তা হলেন উপপরিদর্শক (এসআই) মশিউর রহমান। ঢাকা জেলা পুলিশ সুপার (এসপি) হাবিবুর রহমান তাঁকে প্রত্যাহারের সত্যতা নিশ্চিত করে বলেন, অভিযোগের তদন্ত করতে একজন অতিরিক্ত পুলিশ সুপারকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে।
অপহরণের শিকার ব্যক্তির নাম নূর উদ্দিন। তিনি পরিবার নিয়ে দক্ষিণ কেরানীগঞ্জের কোন্দা ইউনিয়নের জাজিরা গ্রামে থাকেন। কোন্দা ইউনিয়ন শাখা ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি তিনি। এলাকায় তিনি ইটের ব্যবসা করেন।
সরেজমিনে গিয়ে স্থানীয় লোকজন ও ভুক্তভোগীর স্বজনদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, গত ২৩ মে রাত আটটার দিকে দক্ষিণ কেরানীগঞ্জ থানার হাসনাবাদ এলাকা থেকে ডিবি পরিচয়ে কয়েকজন লোক নূর উদ্দিনকে একটি প্রাইভেট কারে তুলে নিয়ে যায়। তাঁর পরিবারের কাছ থেকে দেড় লাখ টাকা দাবি করে অপহরণকারীরা। পরে ৪০ হাজার টাকায় দফারফা হয়। পরিবার প্রাথমিকভাবে বিকাশের মাধ্যমে প্রায় ৩০ হাজার টাকাও পাঠায়। কিন্তু তবু নূর উদ্দিনকে ছাড়া হচ্ছিল না। তাই নূর উদ্দিনের ভাতিজা মোহাম্মদ আলী র্যাব-১০-এর কেরানীগঞ্জ ক্যাম্পে লিখিত অভিযোগ করে নূর উদ্দিনকে উদ্ধারের আবেদন করেন। র্যাবের একটি দল ২৪ মে বেলা ১১টার দিকে কেরানীগঞ্জ মডেল থানার মডেল টাউন এলাকায় একটি খাজা তৈরির কারখানায় অভিযান চালিয়ে নূর উদ্দিনকে উদ্ধার করা হয়। নূর উদ্দিনের হাতে হাতকড়া ও পায়ে শেকল পরা ছিল। র্যাব ওই কারখানা থেকে টনি নামের এক ব্যক্তিকেও আটক করে। টনি র্যাবকে জানান, নূর উদ্দিনকে পাহারা দেওয়ার জন্য তাঁকে রাখা হয়েছে। পরে র্যাব টনিকে কেরানীগঞ্জ মডেল থানায় সোপর্দ করে।
কেরানীগঞ্জ মডেল থানার পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, টনি পুলিশের কাছে স্বীকার করেছেন, ডিবির এসআই মশিউর রহমান ও তাঁর সোর্স মো. রিপন এ অপহরণের ঘটনায় জড়িত।
অবশ্য এ ঘটনায় নূর উদ্দিনের ভাতিজা মোহাম্মদ আলী অপহরণ ও চাঁদাবাজির অভিযোগে রিপন ও টনির বিরুদ্ধে কেরানীগঞ্জ মডেল থানায় মামলা করেন। সেখানে মশিউরকে আসামি করা হয়নি। মামলার আসামি করা না হলেও ঘটনা জানাজানির পর ঢাকা জেলা পুলিশ এসআই মশিউরকে প্রত্যাহার করে।
ঘটনার পর এখনো আতঙ্কে দিন কাটছে নূর উদ্দিন ও মামলার বাদী মোহাম্মদ আলীর। ঘটনার ব্যাপারে তেমন মুখ খুলছেন না তাঁরা। গত ২৬ মে বাসায় গেলে নূর উদ্দিন বাসায় নেই বলে জানান তাঁর স্ত্রী সুরাইয়া বেগম। ঘটনার ব্যাপারে জানতে চাইলে সুরাইয়া বলেন, ‘আমার স্বামীরে পুলিশ ধইরা নিয়া গেছিল। তবে ক্যান নিছিল তা জানি না। তার সঙ্গে কারও কোনো দ্বন্দ্ব নাই।’ স্ত্রীর দেওয়া নূর উদ্দিনের মুঠোফোন নম্বরে যোগাযোগ করা হলে তা বন্ধ পাওয়া যায়।
একই এলাকায় নূর উদ্দিনের ভাতিজা মোহাম্মদ আলীর বাসা। বাসায় গেলে তাঁকেও পাওয়া যায়নি। মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি ঘটনার ব্যাপারে প্রথমে কিছু বলতে রাজি হননি। পরে অনুরোধ করলে তিনি বলেন, তাঁর চাচা নূর উদ্দিন অপহরণ হওয়ার পর তিনি জানতে পারেন এসআই মশিউর ও তাঁর সোর্স রিপন এ ঘটনা ঘটিয়েছেন। পরে তিনি এসআই মশিউরের সঙ্গে সরাসরি দেখা করেন। তখন মশিউর তাঁকে বলেন, ফেনসিডিলসহ নূর উদ্দিনকে আটক করা হয়েছে। দেড় লাখ দিলে ছেড়ে দেওয়া হবে।
র্যাব-১০ কেরানীগঞ্জ ক্যাম্পের কোম্পানি কমান্ডার মেজর শামীম আহমেদ স্বদেশ নিউজ ২৪ ডটকমকে বলেন, তদন্ত করে দেখা গেছে, ওই বাড়িটিতে আগেও বিভিন্ন লোকজনকে নিয়ে এসে হাতকড়া ও শেকল পরিয়ে রেখে ওই বাড়িতে বন্দী রেখে মুক্তিপণ দাবি করা হতো। উদ্ধার হওয়া নূর উদ্দিনও র্যাবকে জানিয়েছেন, তাঁকে ওই বাড়িতে ঢোকানোর পর একজনকে বাড়ি থেকে মুক্তি দেওয়া হচ্ছিল।
র্যাব সূত্র জানায়, ‘সোর্স পরিচয় দেওয়া রিপন এলাকায় নিজেকে ডিবি ও পুলিশ কর্মকর্তা পরিচয় দিতেন। সবসময় সঙ্গে হাতকড়া রাখতেন। আমরা টনিকে গ্রেপ্তার করে থানা-পুলিশকে দিয়েছি তারাই ঘটনার বিস্তারিত তদন্ত করে দেখবেন।’
এদিকে কেরানীগঞ্জ মডেল থানার পুলিশ জানায়, রিপন পলাতক। তবে টনিকে গত সোমবার এক দিনের রিমান্ডে নেওয়া হয়। বর্তমানে তিনি কারাগারে।
রিমান্ডে পাওয়া তথ্য সম্পর্কে জানতে চাইলে মামলার তদন্ত কর্মকর্তা কেরানীগঞ্জ মডেল থানার এসআই এনায়েত কবীর স্বদেশ নিউজ ২৪ ডটকমকে বলেন, ‘পুলিশের কাছে টনি দাবি করেছেন, ঘটনার মূল হোতা রিপন। এ ছাড়া আর কারও নাম তিনি বলেননি। এখন রিপনকে গ্রেপ্তার করা গেলে জানা যাবে আর কারা ঘটনায় জড়িত।’
যোগাযোগ করা হলে মুঠোফোনে এসআই মশিউর স্বদেশ নিউজ ২৪ ডটকমকে বলেন, ‘রিপন ডিবির সোর্সগিরি করত। এ সুযোগে সে নিজেরে এসআই মশিউর পরিচয় দিয়া বিভিন্ন খারাপ কাজ কইরা বেড়াইত। নামের ভুলের কারণে আমার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা আমাকে ক্লোজ করেছেন।’
‘এত কর্মকর্তা থাকতে আপনার নাম কেন?’—এমন প্রশ্ন করলে মশিউর বলেন, ‘তা তো আমি জানি না। রিপনকে ধরতে পারলে জানা যাইত। তারে আমিও খুঁজতাছি। পাইলে জিজ্ঞেস করতাম, সে ক্যান আমার নামটা বলল? ’