পলিসিস্টিক ওভারি সিন্ড্রোম(PCOS)সম্পর্কে লিখা পর্ব-১ এ আপনাদের জানিয়েছিলাম PCOS কি, এর কারন, লক্ষণ, জটিলতা ইত্যাদি সম্পর্কে। এই পর্বে জানাচ্ছি এর চিকিৎসা এবং খাদ্য ব্যবস্থা সম্পর্কে। PCOS থাকা নারীর অস্বাভাবিক ওজন বৃদ্ধি পাওয়া থেকে শুরু করে বাচ্চা না হওয়ার মতো বিভিন্ন শারীরিক সমস্যায় ভোগেন। যদিও এই সমস্যাটি ডায়াবেটিস বা কিডনি রোগের মতো নিরাময় যোগ্য নয় তবে সময় মতো সচেতনতা, চিকিৎসা, স্বাস্থ্যকর খাবার ব্যবস্থা এবং জীবনযাপনের মাধ্যমে একে নিয়ন্ত্রনে রেখে অনেক ভাল থাকা সম্ভব।
কিছু টেস্ট এবং PCOS সনাক্তকরণ-
আসলে এখন পর্যন্ত কোনো নির্দিষ্ট একটি টেস্ট নেই যা দিয়ে PCOS সনাক্ত করা যায়। তাই প্রথমেই PCOS এর লক্ষণ গুলোর বেশ কিছু যদি মিলে যায় তাহলে সেগুলো লিখে রাখতে হবে এবং প্রথমেই একজন ভালো স্ত্রী রোগ বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের কাছে যেতে হবে। ডাক্তার তখন রোগীর শারীরিক অবস্থা পর্যবেক্ষণের করবেন।
শারীরিক অবস্থা পরীক্ষা- মেডিক্যাল হিস্ট্রি দেখবেন, উচ্চতা, ওজন,রক্তচাপ পরীক্ষা করবেন।
পেলভিক পরীক্ষা- রিপ্রোডাক্টিভ অর্গানগুলো সার্বিকভাবে পরীক্ষা করবেন।
রক্ত পরীক্ষা- রক্ত পরিক্ষার মাধ্যমে হরমোনের অস্বাভাবিকতা এবং অ্যান্ড্রোজেন হরমোনের অতিরিক্ত নিঃসরণ সনাক্ত করা যায়।এছাড়া কোলেস্টেরল, ট্রাইগ্লিসারাইড এর মাত্রা পরীক্ষা এবং গ্লুকোজ টলারেন্স টেস্ট(GTT)করতে হবে।
আল্ট্রাসনোগ্রাম- এর মাধ্যমে ওভারির অবস্থা, জরায়ুর পুরুত্ব জানা যায়।
PCOS এর চিকিৎসা
PCOS যদিও নিরাময় যোগ্য নয় তবে এর চিকিৎসার ক্ষেত্রে লক্ষণ গুলো নিয়ন্ত্রন করলে এবং জটিলতা গুলোর সমাধান করার চেষ্টা করলে তারা অনেক ভাল থাকতে পারে। তবে একেক নারীর ক্ষেত্রে তাদের লক্ষণ অনুযায়ী একেক ধরনের চিকিৎসার ব্যবস্থা প্রয়োজন হয়। PCOS এর ক্ষেত্রে শুধুমাত্র ঔষধে প্রতিকার সম্ভব নয়। সবচেয়ে জরুরি বিষয় হচ্ছে জীবন যাপনের ধারায় পরিবর্তন আনা। তারপর কিছু ঔষধ গ্রহন এবং খাদ্যাভ্যাসে পরিবর্তন আনা।
স্বাস্থ্যকর খাবারের মাধ্যমে ওজন কমানো, শারীরিক ব্যায়াম, মেডিটেশন এবং ধূমপান বর্জন। PCOS থাকা নারীদের অবশ্যই শারীরিক ব্যায়াম করতে হবে।
যারা গর্ভধারন করতে চান না তারা জন্ম বিরতিকরণ পিলের মাধ্যমে হরমোনের ভারসাম্য আনবে, পুরুষ হরমোনের মাত্রা কমাতে সাহায্য করবে এবং পিরিয়ড নিয়মিত করতে পারে। এছাড়া এর ফলে ত্বকের সমস্যা এবং ব্রণের সমস্যা ও কমবে।
যদি কারো ডায়াবেটিস থাকে সেটা নিয়ন্ত্রনে রাখতে হবে রক্তের শর্করার মাত্রা নিয়ন্ত্রনে এবং টেস্টোটেরন হরমোনের এর মাত্রা কমাতে।
সে নারীরা বাচ্চা নিতে আগ্রহী তাদের প্রজনন ক্ষমতা বৃদ্ধিতে ঔষধ গ্রহন করতে হবে।
পুরুষ হরমোন অ্যান্ড্রোজেন নিয়ন্ত্রনে ঔষধ গ্রহন করতে হবে। এটা গ্রহনের ফলে মুখের ব্রণ এবং অবাঞ্ছিত চুলের পরিমান কমে যাবে।
রোগীর অবস্থার উপর নির্ভর করে অনেক সময় অপারেশনের ও প্রয়োজন হতে পারে।
চিকিৎসার ক্ষেত্রে উপরোক্ত প্রক্রিয়া গুলো অবশ্যই একজন বিশেষজ্ঞ ডাক্তার এগুলো করবেন।
এবার আসা যাক খাদ্য ব্যবস্থায়
PCOS এর খাদ্য ব্যবস্থা-
PCOS এর ক্ষেত্রে সঠিক খাদ্য ব্যবস্থা একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। কারন চিকিৎসার পাশাপাশি একটি সঠিক খাদ্য ব্যবস্থাই পারে PCOS থাকা একজন নারীকে সুস্থ রাখতে।
বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই দেখা যায় PCOS থাকা নারীদের ওজন স্বাভাবিকের চেয়ে অনেক বেশি থাকে। তাই সুস্থ থাকার অন্যতম উপায় হচ্ছে খাবার নিয়ন্ত্রণ এবং শারীরিক ব্যায়ামের মাধ্যমে ওজন কমিয়ে আনতে হবে। দেহের অতিরিক্ত ওজন যখন কমানো হবে সেই সাথে ডায়াবেটিস এবং হৃদরোগের ঝুঁকিও কমে আসবে এবং গর্ভধারণ করা সহজ হবে। PCOS এর ক্ষেত্রে দৈনিক ক্যালরির ৪০% আসবে প্রোটিন জাতীয় খাবার থেকে, ৩০% আসবে আনস্যাচুরেটেড ফ্যাট থেকে এবং বাকিটা আসবে শর্করা জাতীয় খাবার থেকে।
শর্করা বাদ দেয়া যাবে না
যেহেতু শর্করা জাতীয় খাবার ইন্সুলিনের মাত্রা বৃদ্ধি করে তাই খাবার থেকে শর্করার পরিমান কমাতে হবে। তবে অনেকেই দেখা যায় শর্করা জাতীয় খাবার খুবই কম বা পুরোপুরি বাদ দিয়ে দেন। এটা কোনো ভাবেই উচিত নয়।এটা ভালো করার চেয়ে খারাপই করে বেশি। কারন দীর্ঘদিন যদি শর্করা জাতীয় খাবারের অভাব হয় তাহলে দেহে কিটোন বডি নামে ক্ষতিকর পদার্থ উৎপন্ন হয়। তাই PCOS থাকা নারীদের জানতে হবে যে সব ধরনের শর্করার ভূমিকা এক নয়। জটিল শর্করা বা খাদ্যআঁশ থেকে প্রাপ্ত শর্করা ইন্সুলিনের মাত্রা নিয়ন্ত্রনে রাখতে সাহায্য করে। লো গ্লাইসেমিক সূচকের খাবার গুলো খেতে হবে।
খাদ্যআঁশের পরিমান বাড়াতে হবে
প্রতিদিনের খাবারে কমপক্ষে ২১-২৫ গ্রাম খাদ্যআঁশ রাখতে হবে। যার ফলে সারাদিন পেট ভরা থাকা অনুভুতি থাকবে এবং রক্তের শর্করার মাত্রা এবং কোলেস্টেরলের মাত্রা নিয়ন্ত্রনে রাখতে সাহায্য করবে। কিছু আঁশ জাতীয় খাবার এখানে উল্লেখ করা হলো-
ফল- কমলা, মাল্টা, আপেল, নাস্পাতি, তরমুজ, ডুমুর, বেরি ফল, কিউয়ি, জাম্বুরা, আমড়া ইত্যাদি।
সবজি- ব্রকলি, মটরশুঁটি, শিম, স্কোয়াস, পালংশাক, ডাঁটাশাক, লাউশাক ইত্যাদি।
শষ্য জাতীয়- লাল চাল, ভুসিসহ আটা, গম, বার্লি, অটস, কুউনোয়া, কুসকুস ইত্যাদি।
ডাল- মসুর ডাল, বুটের ডাল, সয়াবিন, কিডনি বিন ইত্যাদি।
সিরিয়াল- অটস, ইসবগুল, গমের ভুষিসহ আটা দিয়ে তৈরি বিভিন্ন ধরনের সিরিয়াল।
বাদাম এবং বিভিন্ন বীজ- কাঠ বাদাম, তিজিবীজ, সূর্যমুখীর বীজ ইত্যাদি।
প্রোটিন জাতীয় খান
খাদ্যআঁশের মতো প্রোটিন জাতীয় খাবার পেট ভরা থাকার অনুভূতি দেয় ফলে ক্ষুধা কম লাগে যা দেহের ওজন কমানোর একটি উত্তম উপায়। প্রতিদিনের খাবার তালিকায় মুরগি, মাছ বা কিছু পরিমান মাংস রাখা উচিত। আর যারা উদ্ভিজ উৎস থেকে প্রোটিন নিতে চান তারা বিভিন্ন ডাল, সয়া বা পোনে এক কাপ বাদাম এবং বিভিন্ন বীজ মিলিয়ে খেতে পারেন।
আনস্যাচুরেটেড ফ্যাট নির্বাচন করুন
খাবারে প্রাণীজ উৎস থেকে প্রাপ্ত অতিরিক্ত স্যাচুরেটেড এবং ট্রান্স ফ্যাট যদি থাকে তাহলে তা ওজন বৃদ্ধি করে, রক্তচাপ বৃদ্ধি ও কোলেস্টেরলের মাত্রা বৃদ্ধি করবে তাই উদ্ভিজ তেল থেকে প্রাপ্ত আনস্যাচুরেটেড ফ্যাট যেমন সূর্যমুখী, ক্যানোলা, ভুট্টার তেল, তিসির তেল, অলিভ ওয়েল, বাদাম তেল, অ্যাভোকাডো তেল ৩০-৪৫ মিলি বা ২-৩ টেবিল চামচ সারাদিনের জন্য গ্রহন করা স্বাস্থ্যকর। তেলে ভাজার পরিবর্তে বেক, গ্রিল, ভাপে সেদ্ধ বা রান্না করে খাবার খান।
বর্জনীয় খাবার
কিছু খাবারের কারনে ওজন বৃদ্ধি পায় তাই যেসব খাবারে চিনি, লবন, রিফাইন ময়দা বা ফ্যাট থাকে সেগুলো বর্জন করতে হবে। যেমন-
চিপস, চকলেট, কেক, জুস, চিনি, বিস্কিট, আইস ক্রিম, ডোনাট, আলু, সাদা চালের ভাত, পাস্তা, দুধ ও দুগ্ধ জাতীয় খাবার, অতিরিক্ত তেলে ভাঁজা খাবার, ফ্রোজেন খাবার, প্রক্রিয়াজাত করা খাবার, চালের পিঠা, প্রক্রিয়াজাত করা মাংস, অতিরিক্ত লবনের স্ন্যাক্স গুলো, বিভিন্ন গ্যাস ড্রিঙ্কস এমনকি কি ডায়েট ড্রিঙ্কস গুলোও। এছাড়া উচ্চ গ্লাইসেমিক সূচকের খাবার গুলো।