পোস্ট অফিসের ২৩ হাজার ২১ কর্মকর্তা-কর্মচারী ধর্মঘটে রয়েছেন। এক সপ্তাহ ধরে তাদের এ আন্দোলনে প্রত্যন্ত অঞ্চলের ডাক যোগাযোগ মাধ্যমে নেমে এসেছে বিপর্যয়। এ নিয়ে ডাক বিভাগে চলছে তোলপাড়। বিভাগীয় অফিসগুলোতে ডাকের স্তূপ জমা হয়েছে। কিন্তু ধর্মঘট থাকায় সেখান থেকে অবিভাগীয় ৮৪৬০টি পোস্ট অফিসে কোনো ডাক পৌঁছছে না। কাজ
করছে না পোস্ট মাস্টার, পোস্ট ম্যান ও রানার। ফলে কোনো ধরনের চিঠিপত্র, রেজিস্ট্রি, মানিঅর্ডার, ইলেকট্রিক মানি অর্ডার বিলিসহ যাবতীয় কাজ বন্ধ রয়েছে; এ অবস্থায় ডাক বিভাগের সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন গ্রাহকরা। এ ব্যাপারে বাংলাদেশ পোস্টাল ইডি কর্মচারী ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক এমএ হাকিম বলেছেন, গ্রামে বসবাসরত ৮০ শতাংশ মানুষের সেবা করেন ইডি কর্মচারীরা। অথচ তাদের সম্মানী ভাতা অত্যন্ত কম; যা দেশে কিংবা বিশ্বের কোথাও এমন নজির নেই। তিনি মানবিক কারণে ইডি কর্মচারীদের দাবি মেনে নেয়ার অনুরোধ জানান। বলেন, এসব দাবি না মানা পর্যন্ত ধর্মঘট অব্যাহত থাকবে। এ ব্যাপারে ডাক বিভাগের মহাপরিচালক প্রবাস চন্দ্র সাহার মতামত জানতে চাইলে তিনি তার দপ্তরের মাধ্যমে জানান, ধর্মঘটের ব্যাপারে মহাপরিচালক কিছু জানেন না। যেহেতু ইডি কর্মচারীরা তাকে লিখিতভাবে কিছু জানাননি সেহেতু তাদের ধর্মঘটের ব্যাপারেও তিনি কিছু বলবেন না। ডাক ও টেলিযোগাযোগ প্রতিমন্ত্রী তারানা হালিম বলেছেন, পোস্টাল ইডি কর্মচারীদের দাবি-দাওয়ার ব্যাপারে আমি অবগত। ধর্মঘটের ব্যাপারেও জানি। তাদের বিষয়গুলো খতিয়ে দেখতে ইতিমধ্যে একটি কমিটি গঠন করে দিয়েছি। কতজনকে স্থায়ী বা একীভূত করা যায় এ কমিটি তার সুপারিশ করবে। প্রতিমন্ত্রী বলেন, একেবারে সবাইকে রাজস্ব খাতে স্থানান্তর করা সম্ভব নয়। ডাক বিভাগের চাকরির বিজ্ঞপ্তি জারি হওয়ার পর তাদের মধ্যে থেকে যতজনকে সম্ভব ততজনকে নিয়োগ করতে বলেছি। তবে দুর্নীতিবাজদের কোনো মতেই নিয়োগ করা হবে না। তারানা হালিম আরও বলেন, গঠিত এ কমিটি ইতিমধ্যে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করেছে। এছাড়া তিনি নিজে ডিজিকে তাদের পেনশনের বিষয়টি দেখার নির্দেশ দিয়েছেন বলে জানান। প্রতিমন্ত্রী অবিভাগীয় কর্মচারীদের কাজে যোগ দেয়ার আহ্বান জানান।
সূত্র মতে, দেশে দুই শ্রেণীর ডাকঘর রয়েছে। বিভাগীয় ও অবিভাগীয়। বিভাগীয় ডাকঘরগুলো সম্পূর্ণ সরকারি রাজস্বখাতভুক্ত। এর কর্মকর্তা-কর্মচারীরা সরকারি বেতন স্কেলে বেতন-ভাত পান। অপরদিকে অবিভাগীয় ডাকঘরের কর্মচারীরা সরকারি বেতন স্কেলে বেতন-ভাতা পান না। তারা শুধু নির্দিষ্ট সম্মানী ভাতা পান। দেশে বিভাগীয় ডাকঘর রয়েছে ১৪২৬টি। আর অবিভাগীয় ডাকঘরের সংখ্যা ৮৪৬০টি। বিভাগীয় ডাকঘরের মধ্যে জিপিও রয়েছে ৪টি, এ গ্রেড প্রধান ডাকঘর ২১টি, বি গ্রেড প্রধান ডাকঘর ৪৫টি, উপজেলা পোস্ট অফিস রয়েছে ৪৮০টি, বিভাগীয় সাব পোস্ট অফিস রয়েছে ৮৬৫টি এবং বিভাগীয় শাখা ডাকঘর রয়েছে ১১টি। অপরদিকে অবিভাগীয় সাব পোস্ট অফিস রয়েছে ৩২২টি ও অবিভাগীয় শাখা ডাকঘর রয়েছে ৮১৩৮টি। অবিভাগীয় ডাকঘরে রয়েছে ২৩ হাজার ২১ জন কর্মচারী। এরমধ্যে এক্সট্রা ডিপার্টমেন্টাল সাব পোস্টমাস্টার (ইডিএসপিএম) রয়েছেন ৩২২ জন। এক্সট্রা ডিপার্টমেন্টাল এজেন্ট (ইডিএ) রয়েছেন ৮১৩৮ জন। এক্সট্রা ডিপার্টমেন্টাল ডেলিভারি এজেন্ট (ইডিডিএ) রয়েছেন ৫৯৬১ জন এবং অন্যান্য ইডি কর্মচারী রয়েছেন ১৩৪৭ জন। অবিভাগীয় ডাকঘরের ইডি সাব পোস্ট মাস্টাররা বর্তমানে ১৬৫০ টাকা সম্মানী ভাতা পান। ইডি কর্মচারীরা তাদের বেতন ৭৫০০ টাকা করার দাবি জানিয়েছে। ইডিএ ব্রাঞ্চ পোস্ট মাস্টাররা বর্তমানে সম্মানী পান ১২৬০ টাকা। ইডি কর্মচারীদের দাবি, তাদের বেতন ৬৫০০ টাকা করার। ইডিডিএ অর্থাৎ চিঠি বিলিকারীরা বর্তমানে সম্মানী পান ১২৩০ টাকা। তাদের সম্মানী ৬০০০ টাকা করার দাবি ইডি কর্মচারীদের। ইডিএমসি ডাক বহনকারীরা বর্তমানে ১১৮০ টাকা সম্মানী পান। তাদের ক্ষেত্রে ৫৫০০ টাকা করার দাবি জানিয়েছে। অন্যান্য ইডি কর্মচারীরা যেমন চৌকিদার, ঝাড়ুদার সম্মানী ভাতা পান ১১৩০ টাকা। তাদের সম্মানী ভাতা ৫০০০ টাকা করার দাবি জানান ইডি কর্মচারীরা। বাংলাদেশ পোস্টাল ইডি কর্মচারী ইউনিয়ন এ দাবি নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে আন্দোলন করে আসছে। এ নিয়ে ২০১৪ সালের ৩১শে ডিসেম্বর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বরাবর দাবিনামা পেশ করা হয়। পোস্টাল ইডি কর্মচারী ইউনিয়নের অন্যান্য দাবির মধ্যে রয়েছে- দুই মাসের সম্মানী ভাতার সমপরিমাণ দুটি উৎসব ভাতা দেয়ার দাবি, বাংলা নববর্ষ ভাতার দাবি, প্রত্যেক ই-সেন্টারে নাইটগার্ড নিয়োগের দাবি এবং এফ বন্ডের টাকা দিয়ে কল্যাণ ট্রাস্ট গঠন করার দাবি জানিয়েছে। বাংলাদেশ পোস্টাল ইডি কর্মচারী ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক এম এ হাকিম বলেছেন, আন্দোলন ছাড়া দাবি আদায় হবে না। সরকার প্রজাতন্ত্রের সকল সরকারি বেসরকারি কর্মকর্তা কর্মচারীদের বেতন-ভাতা বাড়িয়েছে। পরিতাপের বিষয়, ডাক বিভাগের অবিভাগীয় কর্মচারীদের সম্মানী ভাতা এখনও ১২০০ টাকা। গত এক বছর আগে কর্তৃপক্ষ ঘোষণা করেছিল, সরকারি কর্মচারীদের জাতীয় পে-স্কেল কার্যকর হলেই ইডি কর্মচারীদের সম্মানী ভাতা বাড়ানো হবে। কিন্তু গত দুই মাস আগে আমাদের বর্তমান সম্মানী ভাতার ১০০% বৃদ্ধির একটি প্রস্তাব ডাক মন্ত্রণালয় অর্থ মন্ত্রণালয়ে পাঠায়। যা বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেই। ঘোষণাও নেই। এরই পরিপ্রেক্ষিতে কর্মচারীদের কাঙ্ক্ষিত দাবি আদায়ে গত ৭ই জানুয়ারি এক সভায় আন্দোলনের মাধ্যমে দাবি আদায়ের কর্মসূচি ঘোষণা করে। এ লক্ষ্যেই গত ১৪ই মার্চ থেকে দেশের ৮৪৬০ পোস্ট অফিসে তালা দিয়ে আমরা ধর্মঘট করছি। দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত ই-সেন্টারসহ দেশের সকল শাখা ডাকঘরে ডাক সার্ভিসের কাজ বন্ধ থাকবে। এমএ হাকিম বলেছেন, আমাদের আন্দোলন ধামাচাপা দিতে ডিজি প্রবাস চন্দ্র সাহা একটি চিঠি ইস্যু করেছে বলে শুনেছি। যে চিঠিতে তিনি বিভাগীয় রানারদের সকল শাখায় চিঠি পৌঁছে দেয়ার নির্দেশ দিয়েছেন। আমার কথা, এমন অবাস্তব নির্দেশ তিনি দেন কিভাবে? আমি বলতে চাই, ডিজি এসব চিন্তা না করে অন্তত বর্তমান সম্মানী ভাতার ১০০ ভাগ বাড়ানোর যে প্রস্তাব অর্থ মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে তার অনুমোদন আনার চেষ্টা করলে ভালো হবে। আর এটা করলেও ধর্মঘট প্রত্যাহার করে নিতে পারতাম।