নকশায় ত্রুটি নিয়েই গত বুধবার খুলে দেয়া হয় মগবাজার-মৌচাক ফ্লাইওভারের সাতরাস্তা থেকে হলি ফ্যামিলি পর্যন্ত অংশ। এর পর থেকেই দেখা দিচ্ছে নানা জটিলতা। ফ্লাইওভারে ওঠানামায় ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে মোটরযান চালকদের। ওঠার রাস্তা বেশি খাড়া হওয়ায় ফ্লাইওভার এড়িয়ে চলছে বাস-ট্রাক। তার পরও ওঠার মুখে প্রায়ই সৃষ্টি হচ্ছে যানজট। এ অবস্থায় ফ্লাইওভারটির ত্রুটি খুঁজতে তিন সদস্যের একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। অন্যান্য ফ্লাইওভারের পরিকল্পনায় ত্রুটি আছে কিনা, তাও খতিয়ে দেখবে এ কমিটি।
পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়-সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির ২২তম বৈঠকে এ কমিটি গঠন করা হয়। তিন সদস্যের কমিটির আহ্বায়ক করা হয়েছে সংসদ সদস্য মো. তাজুল ইসলামকে। কমিটির অন্য দুই সদস্য হলেন— সামশুল হক চৌধুরী ও মুহিবুর রহমান মানিক। তদন্তের স্বার্থে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) ও স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরের (এলজিইডি) প্রকৌশলীদের মতামত নেবে এ কমিটি। পাশাপাশি সরেজমিন প্রকল্প পরিদর্শনও করবে তারা।
যোগাযোগ করা হলে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়-সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি আবুল কালাম আজাদ বণিক বার্তাকে বলেন, ঢাকা শহরে ফ্লাইওভারগুলো তৈরি করা হয়েছিল যানজট কমানোর জন্য। কিন্তু ফ্লাইওভারগুলোয় গাড়ি ওঠা ও নামার স্থানে যানজটের সৃষ্টি হয় বলে কমিটির কিছু কিছু সদস্য অভিযোগ করেছেন। এ কারণে এসব ফ্লাইওভারের পরিকল্পনায় কোনো ত্রুটি ছিল কিনা, তা খতিয়ে দেখবে এ কমিটি।
তিনি আরো জানান, বুয়েট, স্থানীয় সরকার ও সড়ক মন্ত্রণালয়সহ যেসব প্রকৌশলী রয়েছেন, তাদের সঙ্গে কথা বলে ও সরেজমিন পরিদর্শনের মাধ্যমে তদন্ত প্রতিবেদন তৈরি করবে কমিটি। এক মাসের মধ্যে কমিটিকে প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হয়েছে।
উল্লেখ্য, বাংলাদেশে সব ধরনের মোটরযান ডান হাতে চালিত হলেও মগবাজার-মৌচাক ফ্লাইওভারটির নকশা করা হয়েছে বাম হাতে চালিত গাড়ির কথা মাথায় রেখে। এটি নির্মাণও করা হচ্ছে সেভাবেই। এতে ফ্লাইওভারে ওঠার রাস্তা অনেক বেশি খাড়া হয়ে গেছে। আর নামার অংশটি অনেক বেশি প্রসারিত। এ অবস্থার মধ্যেই গত বুধবার ফ্লাইওভারটির সাতরাস্তা থেকে মগবাজার হয়ে হলি ফ্যামিলি পর্যন্ত অংশ খুলে দেয়া হয়েছে।
খুলে দেয়ার পর থেকেই ফ্লাইওভার ও আশপাশ এলাকায় প্রচণ্ড যানজটের সৃষ্টি হয়। যানজট দেখা যায় ফ্লাইওভারের ওপরেও। এতে ফ্লাইওভারের ওপর দিয়ে সাতরাস্তা থেকে হলি ফ্যামিলি হাসপাতাল পর্যন্ত যেতে এক-দেড় ঘণ্টা লেগে যায়। পরে যানজট ক্রমেই বাড়তে থাকে এবং সাতরাস্তা থেকে মহাখালী পর্যন্ত তা ছড়িয়ে পড়ে।
একই চিত্র দেখা যায় গতকাল সকালেও। প্রচণ্ড যানজট দেখা যায় ফ্লাইওভারের ওপর ও নামার সড়কে। ফলে বাধ্য হয়ে অনেকে সাতরাস্তা থেকে হলি ফ্যামিলি পর্যন্ত নিচের সড়ক দিয়েই যাতায়াত করেন। তবে দুপুরের দিকে অবস্থা স্বাভাবিক হয়ে আসে। আবার সন্ধ্যায় ফ্লাইওভারে যানজট সৃষ্টি হয়।
সরেজমিনে দেখা যায়, ওঠার সমস্যার কারণে গতকাল বেশির ভাগ বাস, ট্রাক ও কাভার্ড ভ্যান ফ্লাইওভার এড়িয়ে চলাচল করে। বেলা ১১টা থেকে দুপুর সাড়ে ১২টা ও বেলা ২টা থেকে ৩টা পর্যন্ত দুই দফায় মাত্র ১৩টি বাস ফ্লাইওভারে উঠতে দেখা যায়। যদিও ওই সময়ে নিচের সড়ক দিয়ে ২১৪টি বাস অতিক্রম করে। কয়েকটি পণ্যবাহী পিকআপ ফ্লাইওভারে উঠতে গিয়ে বিপাকে পড়ে। অনেক ধীরে ওপরে উঠতে হয় এগুলোকে।
গাজীপুর পরিবহনের চালক মো. মোখলেসউদ্দিন জানান, বুধবার উদ্বোধনের পর দুপুরে একবার ফ্লাইওভারের ওপরে উঠেছিলেন। সাতরাস্তা দিয়ে উঠতে গিয়ে একবার গাড়ি বন্ধই হয়ে যায়। গিয়ার বাড়িয়ে অনেক কষ্টে উঠতে হয় সেবার। এর পর থেকে প্রতিবারই নিচের সড়ক দিয়ে যাতায়াত করছেন তিনি।
কয়েকজন মোটরসাইকেলচালকও ফ্লাইওভারে ওঠানামা কঠিন বলে অভিযোগ করেন। তারা জানান, দূর থেকে গতি বাড়িয়ে না এলে ফ্লাইওভারে ওঠা দুষ্কর। আবার নামার র্যাম্প অনেক প্রসারিত হওয়ায় গতি কমিয়েও ভারসাম্য ঠিক রাখা কঠিন হয়ে পড়ে। ঢাকার কোনো ফ্লাইওভারেই এ ধরনের সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়নি বলে জানান তারা।
তথ্যমতে, মগবাজার-মৌচাক ফ্লাইওভার নির্মাণে সম্ভাব্যতা যাচাই হয় ২০০৪ সালে। আর নকশা প্রণয়ন করা হয় ২০০৫ সালে। তবে স্বাধীন কোনো পরামর্শক দিয়ে যাচাই-বাছাই (ভেটিং) করা হয়নি ফ্লাইওভারটির নকশা। ফলে নকশার ত্রুটি ধরা পড়েনি সে সময়। আবার ২০১১ সালে প্রকল্পটি চূড়ান্ত অনুমোদন ও ২০১৩ সালে নির্মাণ শুরুর আগেও ফ্লাইওভারের নকশা রিভিউ করা হয়নি।
এসব ত্রুটির পেছনে কারা দায়ী, তা খুঁজে বের করতে তদন্ত কমিটিকে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। কমিটি গঠন-সংক্রান্ত বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, ঢাকা শহরে নির্মিত বিভিন্ন ফ্লাইওভারের পরিকল্পনা-সংক্রান্ত ত্রুটির কারণে প্রায়ই এসবের শেষ প্রান্তে অবর্ণনীয় যানজটের সৃষ্টি হয়, যা জনভোগান্তির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। তাই নির্মাণাধীন মগবাজার-মালিবাগ ফ্লাইওভারের পরিকল্পনায় কোনো ত্রুটি ছিল কিনা, থাকলে তাতে কারা জড়িত, তা পর্যবেক্ষণের জন্য তিন সদস্যের সাব-কমিটি গঠন করা হলো।
এ বিষয়ে কমিটির আহ্বায়ক মো. তাজুল ইসলাম বলেন, কোন পরিকল্পনার ভিত্তিতে ফ্লাইওভারটি করা হয়েছে, সেটিই মূলত দেখবে কমিটি। মগবাজার-মৌচাক ছাড়াও অন্যান্য ফ্লাইওভার প্রকল্পগুলোর পরিকল্পনা কিসের ভিত্তিতে করা হচ্ছে, সেটিও খতিয়ে দেখা হবে। কমিটির সদস্যরা মনে করেন, এসব ফ্লাইওভারের পরিসর আরো বড় আকারে করা হলে তাতে ব্যয় কিছুটা বাড়লেও সুবিধাভোগীর সংখ্যা বেশি হতো। এসব বিষয় খতিয়ে দেখার জন্য কমিটি গঠন করা হয়েছে।