এইচ.এম. ইমরান || দিনটা ছিল ২০০৪ সালের ২১ শে আগস্ট রোজ শনিবার বিকেল বেলা। এক ভয়াবহ স্মৃতি বিজড়িত তারিখ। অন্যদিনের মত এই দিনটিও নগরীর এক কোলাহল পূর্ণ বিকেল ছিল। চারিদিকে ছিল স্নিগ্ধতা, মায়া ভরা এক যান্ত্রিক শহর।
সে বছরই আমি প্রথম ঢাকায় আসি। তখন ক্লাস টেনে পড়ি আমি। পুরান ঢাকায় থাকার সুবাদে কিছু বন্ধুবান্ধব হয় আমার। তাদের সাথে নিয়মিত তখন উসমানি উদ্যানে ক্রিকেট খেলতে যেতাম।রীতিমত সেদিনওও আমরা খেলতে গিয়েছিলাম।
সেদিন রাজধানীর বঙ্গবন্ধু এভিনিউতে আওয়ামী লীগের দলীয় কার্যালয়ে সন্ত্রাসবাদ বিরোধী সমাবেশে প্রধান অতিথি হিসেবে বক্তব্য রাখছিলেন তৎকালীন বিরোধী দলের নেতা শেখ হাসিনা। অস্থায়ী ভাবে বানানো মঞ্চে বক্তব্য শেষ করার সাথে সাথেই শেখ হাসিনাকে লক্ষ্য করে রাষ্ট্রীয় মদদে একের পর এক গ্রেনেড ছোড়া হয়। সেসময় মঞ্চে থাকা আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতা মেয়র মোহাম্মদ হানিফসহ শেখ হাসিনার ব্যাক্তিগত নিরাপত্তাকর্মীরা মানবঢাল তৈরী করে রক্ষা করেন প্রাণের নেত্রীকে।
উপর্যুপরি গ্রেনেডের বিস্ফোরণে মুহুর্তেই সমাবেশস্থল পরিণত হয় মৃত্যুপুরীতে।ঘাতকদের গ্রেনেডের স্প্রীন্টারে দেহ থেকে পা বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় তৎকালীন বাংলাদেশ মহিলা আওয়ামী লীগের সভানেত্রী আইভী রহমানের।
হঠাৎ করেই চেনা জগৎটা অচেনা হয়ে গেল। কালো ধোয়ায় ছেয়ে যায় আকাশ।সাথে সাথেই আমাদের খেলায় ছেদ পড়ে। মানুষ দিশেহারা হয়ে দিগ্বিদিক ছুটতে থাকে। কৌতুহল মেটাতে আমরা ক’জন তৎক্ষণাৎ ছুটে যায় সমাবেশস্থলে। যে দৃশ্য আজও বর্ণনা করতে গেলে অবচেতন মনেই আমি খেয় হারিয়ে ফেলি, গলায় জড়তা চলে আস।
গিয়ে দেখতে পায় পরাজিত শক্তির এক নারকীয় হত্যাযজ্ঞ। বিরোধী দলের নেতাকে এবং তার আদর্শকে চিরতরে নি:শেষ করে দেবার এই হীন অপচেষ্টা ইতিহাসে বিরল। এখানে সেখানে পড়ে আছে সভাস্থলে আসা মানুষের বিচ্ছিন্ন হওয়া দেহ। ভ্যান রিকশায় যেভাবে পারা যায় মানুষ আহতদের নিয়ে যাচ্ছিল ঢাকা মেডিকেলের উদ্দেশ্যে।
এই কচি মন আর বেশীক্ষণ এই মৃত্যুপুরীতে থাকার ধৈর্য্য কিংবা ক্ষমতা সবই হারিয়ে ফেলে। বিদ্ধস্থ মনে বাড়ী ফেরার পথে যখনিই গলিতে ঢুকলাম তখনই শুনতে পাচ্ছিলাম গগনবিদারী কান্না। কারন আমি যে এলাকায় থাকতাম তৎকালীন ৬৯ নং ওয়ার্ড এর যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক বেলাল ভাইও এই হামলায় নিহত হন। মূলত তিনি আমার প্রতিবেশী ছিলেন, আমাকে খুব স্নেহ করতেন তিনি।
বুকে একরাশ কষ্ট নিয়ে সেদিন দাফন করতে হয়েছিল প্রিয় বেলাল ভাইকে।
বাসায় গিয়ে যখন বিটিভিতে খবর দেখছিলাম খুব আগ্রহ করে তখন খুবই হতাশ হলাম। কারন বিটিভি ৩০ সেকেন্ডের একটি ফুটেজ দেখিয়ে কোন রকম দায়সারা একটা নিউজ করেছিল। সেদিন থেকে আজ অবধি আমার বিটিভির দর্শক হয়ে উঠা হয়নি।
এর কিছুক্ষণ পরই শুনতে পাচ্ছিলাম ভৈরব কুলিয়ারচরের মাটি ও মানুষের নেতা তৎকালীন বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি জিল্লুর রহমানের সহধর্মিণী আমাদের মা আইভী রহমানের জীবন সংকটাপন্ন। অবশেষে তিনি ২৪ শে আগস্ট মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন।
সেদিনের সে নারকীয় হামলায় আইভী রহমানসহ ২২ জন নেতাকর্মী প্রাণ হারিয়েছিলেন। আহত হয়েছিলেন প্রিয় নেত্রী শেখ হাসিনাসহ শতাধিক নেতাকর্মী।
নেত্রীকে তখন নিরাপদে সুধা সদনে নিয়ে যেতে পারলেও তিনি মারাত্মকভাবে আহত হন। গ্রেনেডের বিকট শব্দে তার শ্রবণশক্তি মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়।সেদিন থেকেই এই কচি মনে জন্ম নিতে থাকে বঙ্গবন্ধুর হাতেগড়া আওয়ামী লীগের প্রতি ভালবাসা। যদিও আমরা পারিবারিক ভাবেই আওয়ামী বলয়ে বেড়ে উঠেছি। এখনও শেখ হাসিনাকে তাড়া করে ফেরে পরাজিত শক্তির সেই বুলেট বুলেট। এই রাষ্ট্র যদি এই হীন চক্রান্তকারীদের সমূলে উপড়ে ফেলতে না পারে তাহলে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের চেতনা অর্থহীন হয়ে যাবে।