মোবাইল ফোনের নম্বর পরিবর্তন না করে অন্য অপারেটরের সেবা নেওয়ার সুযোগ (এমএনপি) নির্ধারিত সময়েই পাবেন গ্রাহকেরা। আগামী জানুয়ারি বা ফেব্রুয়ারিতে এমএনপি সুবিধা দিতে নীতিমালা তৈরি করে কাজ শুরু করেছিল সরকার।
এমএনপি নীতিমালায় ইতিমধ্যে সায় দিয়েছে অর্থ মন্ত্রণালয়। এর আগে গত সেপ্টেম্বরে ওই নীতিমালায় অনুমোদন দেয় প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়।
গতকাল বুধবার রাজধানীর একটি হোটেলে সাংবাদিকদের এ তথ্য নিশ্চিত করে ডাক, তার ও টেলিযোগাযোগ প্রতিমন্ত্রী তারানা হালিম বলেন, ‘অতি শিগগিরই এমএনপি চালু হতে যাচ্ছে। আমাদের কাছ থেকে প্রধানমন্ত্রীর সম্মতির পর অর্থ মন্ত্রণালয়ের যে অনুমতি চাওয়া হয়েছে, তা-ও দিয়ে দেওয়া হয়েছে। এখন বিটিআরসি সেবাটি চালুর বিষয়ে মোবাইল অপারেটরদের জানিয়ে দেবে।’
এর আগে গত সেপ্টেম্বরে প্রতিমন্ত্রী জানিয়েছিলেন, আগামী বছরের শুরুতে জানুয়ারি বা ফেব্রুয়ারিতে গ্রাহকেরা এমএনপি সেবা পেতে শুরু করবেন। ডিসেম্বরের মধ্যে এমএনপি-প্রক্রিয়া চূড়ান্ত করার আশাবাদ প্রকাশ করেছিলেন তিনি।
মন্ত্রণালয় সূত্র জানিয়েছে, এমএনপি-সুবিধা পেতে গ্রাহকের কাছ থেকে ৩০ টাকা আদায়ের প্রস্তাবেও অনুমোদন দিয়েছে অর্থ মন্ত্রণালয়। সূত্র জানায়, অর্থ মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন পাওয়ায় এমএনপি বাস্তবায়নের কাজ অনেকটা এগিয়ে গেল। এখন এমএনপি সেবা পরিচালনা করতে বিটিআরসি একটি প্রতিষ্ঠানকে নিয়োগ দেবে।
এমএনপি চালু হলে মোবাইল গ্রাহকেরা তাঁদের প্রয়োজন ও পছন্দ অনুযায়ী যেকোনো মোবাইল কোম্পানির সেবা নিতে পারবেন। সেবায় সন্তুষ্ট না হলে কিংবা অন্য কোম্পানির বিশেষ সেবা নিতে চাইলে নম্বর পরিবর্তন না করেই যেকোনো কোম্পানির সেবা গ্রহণের সুযোগ পাবেন গ্রাহকেরা। টেলিযোগাযোগ খাতের বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, এতে কোম্পানিগুলোর মধ্যে প্রতিযোগিতা ও সেবার মান বাড়বে। এ ক্ষেত্রে গ্রাহকদের সবচেয়ে বড় সুবিধা হবে অপারেটর নির্ধারণে তাঁদের ‘স্বাধীনতা’। তাঁদের মতে, নম্বর ঠিক রেখে নেটওয়ার্ক বদল গ্রাহকদের স্বাধীনতা।
এমএনপি-সুবিধা নিতে গ্রাহকদের সর্বোচ্চ খরচ হবে ৩০ টাকা। আবেদনের তিন দিনের মধ্যে গ্রাহককে এ সেবা দিতে হবে এবং কোনো গ্রাহক যদি একবার অপারেটর বদলের পর আবারও অপারেটর বদল করতে চান, তাহলে তাঁকে ৪৫ দিন অপেক্ষা করতে হবে। অর্থাৎ, কমপক্ষে ৪৫ দিন অপারেটরের সেবা নিতে হবে। প্রিপেইড ও পোস্ট পেইড উভয় ধরনের গ্রাহকই এমএনপি-সুবিধা পাবেন।
গ্রাহকের স্বাধীনতার বিষয়টি মাথায় রেখে ২০১৩ সালের ১৩ জুন দেশের সব মোবাইল কোম্পানিকে এমএনপি চালু করার নির্দেশ দিয়েছিল বিটিআরসি। এ জন্য সাত মাস সময় বেঁধে দিয়েছিল টেলিযোগাযোগ খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থাটি।
কিন্তু বিটিআরসির এই নির্দেশনা পাওয়ার পরপরই মোবাইল কোম্পানিগুলো ওই সময়ের মধ্যে এমএনপি চালু করা সম্ভব নয় বলে জানিয়ে দেয়। এ নিয়ে নানামুখী আলোচনা চলতে থাকলেও এর মধ্যে সময় শেষ হয়ে যায়। তৈরি হয় দীর্ঘসূত্রতা। পরে বিটিআরসির তত্ত্বাবধানে এমএনপি চালু করতে নতুন গাইডলাইন তৈরি করে সরকারের কাছে দেওয়া হয়।
বিশ্বের মোবাইল অপারেটরদের সংগঠন জিএসএমএ ইন্টেলিজেন্সের এক প্রতিবেদনে দেখা যায়, ২০০৮ সালের নভেম্বরে তুরস্কে এমএনপি চালু হওয়ার পর সেখানকার শীর্ষ অপারেটর টার্কসেল প্রতিদ্বন্দ্বী অ্যাভিয়া ও ভোডাফোনের কাছে গ্রাহক হারাতে থাকে। টার্কসেলের এক প্রতিবেদনকে উদ্ধৃত করে জিএসএমএ বলেছে, এমএনপির কারণে ২০০৮ থেকে ২০১৩ সালের মধ্যে তাদের বাজার ৫৬ থেকে ৫১ শতাংশে নেমে এসেছিল। গ্রাহক হারানোর পরিমাণ এত বেশি ছিল যে, মোবাইল সেবার দাম কমানো এবং সেবার মান বাড়ানোর দিকে তাদের মনোযোগ দিতে হয়েছে।
বর্তমানে বিশ্বের ৭০টির মতো দেশে এমএনপি চালু রয়েছে। জিএসএমের গবেষণা অনুযায়ী, উন্নয়নশীল দেশগুলোর মাত্র এক-চতুর্থাংশ এ সেবা চালু করেছে। ১৫ শতাংশ ভবিষ্যতে চালু করার পরিকল্পনা করছে। বাকি ৬০ শতাংশই এমএনপি চালু করার বিপক্ষে রয়েছে অথবা এখন পর্যন্ত সিদ্ধান্ত নেয়নি।
দক্ষিণ এশিয়ায় পাকিস্তান ও ভারত এমএনপি চালু করেছে যথাক্রমে ২০০৭ ও ২০১১ সালে। তবে নিরাপত্তা বিঘ্নিত হওয়ার আশঙ্কায় তিন বছর পর পাকিস্তান এ সেবা বন্ধ করে দেয়।
উন্নয়নশীল দেশগুলোর মধ্যে ব্রাজিল, নাইজেরিয়া, তুরস্ক, মেক্সিকো ও দক্ষিণ আফ্রিকাও ইতিমধ্যে এমএনপি চালু করেছে। টেলিযোগাযোগ খাতে বিশ্বের সবচেয়ে বড় বাজার চীন এ বছরের মধ্যে সেবা চালু করার পরিকল্পনা নিয়ে কাজ করছে।
জিএসএমের গবেষণা অনুযায়ী, এশিয়া ও আফ্রিকার অনেক দেশের মধ্যে এ সেবা চালু করার বিষয়ে তেমন আগ্রহ নেই। এমএনপি সেবা ব্যয়বহুল হবে—এ চিন্তা থেকে মালদ্বীপ ও উগান্ডা ইতিমধ্যে এর বাস্তবায়নের সিদ্ধান্ত বাতিল করেছে। পাশাপাশি ৮ শতাংশ দেশ, যেগুলোতে মাত্র একটি মোবাইল অপারেটর রয়েছে তাদের জন্য এমএনপি প্রযোজ্য নয়।
ভারতে মাত্র ১১ রুপি খরচ করে এমএনপি সেবা নেওয়া যায়। থাইল্যান্ডে এ সেবার জন্য খরচ হয় ৯৯ বাথ। মালয়েশিয়া, হংকং, যুক্তরাজ্যসহ বেশির ভাগ দেশেই সেবাটির জন্য কোনো মূল্য দিতে হয় না।
বিভিন্ন দেশে নম্বর পরিবর্তনের অনুরোধ পাওয়ার পর সর্বোচ্চ ৩০ দিন থেকে সর্বনিম্ন কয়েক সেকেন্ড লাগে। ভারতে এ সেবা পাওয়া যায় সর্বোচ্চ সাত দিনের মধ্যে। যুক্তরাজ্যে লাগে পাঁচ দিন, যুক্তরাষ্ট্রে দুই ঘণ্টা, অস্ট্রেলিয়ায় তিন মিনিট। আর নিউজিল্যান্ডে লাগে মাত্র কয়েক সেকেন্ড।