মাথায় কালো টুপি, পরনে কালো গাউন। চোখে-মুখে আনন্দের ঝিলিক। একটু পরই নাম ডাকবে তাঁর। জীবনের ঝুলিতে জমা হবে সফলতার এক সনদ। ভেতর ভেতর টান টান উত্তেজনা কাজ করছিল তাঁর। যথারীতি একজনের পর একজনকে ডাকা হচ্ছে। তাঁর পালাও এল। সবাই নিজের নাম শুনে মঞ্চে যতটা দ্রুত পায়ে এগিয়ে গেছেন, ততটা দ্রুত তিনি যেতে পারলেন না। একহাতে ক্রাচ, অন্য হাতে ভাইকে ধরে মঞ্চে উঠলেন। শিক্ষক যখন তাঁর হাতে সনদ তুলে দিলেন, মঞ্চ যেন করতালিতে ফেটে পড়ছে।
করতালি শব্দে পেছনে ফিরে তাকিয়ে তিনি দেখলেন সনদপ্রাপ্ত শিক্ষার্থীরাসহ সবাই দাঁড়িয়ে করতালি দিয়ে তাঁকে অভিবাদন জানাচ্ছেন। তিনি বলেন, এটা তাঁর জীবনের খুব খুব গর্বের একটি মুহূর্ত।
এতক্ষণ ধরে যাঁর কথা বলছি, তিনি হলেন ‘আফগানিস্তানের মালালা’। তাঁর নাম ব্রেসনা মুজাজাই। ছোটবেলায় পোলিওতে এক পা অচল। অন্য পা তালেবানের গুলিতে ক্ষতবিক্ষত। তবে এসবের কিছুই দমাতে পারেনি তাঁকে।
গত ১১ মে কাবুলে আমেরিকান ইউনিভার্সিটি অব আফগানিস্তান থেকে তিনি আইন বিষয়ে স্নাতকের সনদ লাভ করেন। ১৩৯ জন শিক্ষার্থী ওই দিন এই ডিগ্রির অধিকারী হলেও সবার মধ্যে হয়ে জ্বলজ্বল করছিলেন ব্রেসনা।
চলতি মাসে ইউনিসেফের এক হিসাবে বলা হয়, আফগানিস্তানে ৭ থেকে ১৭ বছর বয়সী ছেলেমেয়েদের অর্ধেক স্কুলে যায় না। এর মধ্যে ৬০ শতাংশই মেয়ে। এমনকি সরকার নিয়ন্ত্রিত অঞ্চলগুলোতেও স্কুল শেষ করে মেয়েদের কলেজে যাওয়ার হার খুব কম। অনেক রক্ষণশীল পরিবারই বয়ঃসন্ধির পর মেয়েদের স্কুলে যাওয়ার চেয়ে বিয়ে দেওয়াকে উপযুক্ত মনে করে।
তালেবান হামলার হুমকির মুখে সম্প্রতি দেশটির পূর্বাঞ্চলীয় নানগাহার প্রদেশে মেয়েদের প্রায় ৮০টি স্কুল বন্ধ করে দেওয়া হয়। এমন সমাজে ব্রেসনা এক সাহসের নাম। শারীরিক ও সামাজিক প্রতিবন্ধকতা কাটিয়ে তাঁর অধ্যবসায়ের গল্প এখন সবার মুখে মুখে।
মধ্যবিত্ত পরিবারে জন্ম ব্রেসনার। বাবা সালেহ মোহাম্মদ মালাংয়ের স্বপ্ন ছিল মেয়ে শিক্ষিত হবে। কষ্ট করে মেয়ের পড়ার খরচ জুগিয়েছেন এই সাবেক সাংসদ। সাহেল মোহাম্মদ মালাং ওয়াশিংটন পোস্টকে বলেন, ‘আমরা চেয়েছি সে পড়াশোনা করে ভবিষ্যতে স্বাধীন ও আত্মনির্ভরশীল মানুষ হোক।’
ক্রমাগত যুদ্ধ, হামলা সব মিলিয়ে অস্থিরতার হাত থেকে বাঁচতে ব্রেসনার জন্মের আগেই তাঁর পরিবার পাকিস্তানে চলে যায়। ব্রেসনা সেখানেই তাঁর প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষা শেষ করেন। পাশাপাশি ইংরেজি ভাষা ও কম্পিউটারেও দক্ষ হয়ে ওঠেন। ২০১১ সালে নিজ দেশ আফগানিস্তানে পরিবারের সঙ্গে ফিরে আসেন ব্রেসনা। ভর্তি হন আমেরিকান ইউনিভার্সিটিতে আইন বিষয়ে। সেখানে ছেলেমেয়েরা একসঙ্গে পড়াশোনা করেন।
পোলিওর কারণে অচল পা নিয়ে হাঁটতে খুব কষ্ট হয় ব্রেসনার। তাঁদের বাড়িটি ছয়তলায়। লিফট নেই। প্রতিদিন তিনি সিঁড়ি ভাঙেন। শরীর টেনে তুলতে তুলতে কখনো কখনো বমি হয়ে যায় তাঁর। পিঠ, পা ও মাথায় তীব্র ব্যথা হয়।
নারী শিক্ষা অধিকার কর্মী মালালা ইউসুফজাইয়ের ওপর যেভাবে হামলা চালিয়েছিল তালেবানরা, সেভাবে হামলার শিকার হন ব্রেসনা।
২০১৬ সালের ২৪ আগস্ট তাঁর জীবনটাকে আরও দুঃসহ করে তোলে এক হামলা। ক্যাম্পাসের মসজিদে বিকেলে নামাজ পড়তে যাচ্ছিলেন শিক্ষার্থীরা। এ সময় তালেবানেরা হামলা চালায়। শুরু হয়ে যায় ছুটোছুটি। এদিক-সেদিক শিক্ষার্থীরা আশ্রয় নেয়। ব্রেসনা কাছের একটি ভবনে আশ্রয় নিতে আপ্রাণ চেষ্টা করছিলেন। কিন্তু অন্যদের মতো ছুটতে পারছিলেন না। শেষে ব্রেসনা মসজিদে ঠাঁই নেন। একসময় গুলির শব্দ থেমে যায়। তালেবানরা মসজিদেও পাছে ঢুকে পড়ে, সে চিন্তা করে সেখান থেকে অন্য আরেকটি ভবনে যাওয়ার চেষ্টা করেন ব্রেসনা। কিন্তু মাঝপথে পুলিশের পোশাকে থাকা এক জঙ্গি তাঁর পায়ে গুলি করে। খাড়া অবস্থা থেকে মাটিতে লুটিয়ে পড়েন তিনি। এরপর ওই দুর্বৃত্ত আবারও গুলি করে ব্রেসনাকে। তীব্র ব্যথা নিয়ে মড়ার মতো প্রায় ছয় ঘণ্টা পড়ে ছিলেন তিনি, যাতে কোনোভাবেই সন্ত্রাসীরা টের না পায় তিনি বেঁচে আছেন।
স্নাতক ডিগ্রিধারী সনদপ্রাপ্তদের সারিতে সবার আগে ব্রেসনা। ছবিটি আফগান মানবাধিকারকর্মী সারাহ ফেতরাতের টুইটার থেকে নেওয়া।
স্নাতক ডিগ্রিধারী সনদপ্রাপ্তদের সারিতে সবার আগে ব্রেসনা। ছবিটি আফগান মানবাধিকারকর্মী সারাহ ফেতরাতের টুইটার থেকে নেওয়া।
মধ্যরাতে পুলিশ যখন তাঁকে উদ্ধার করে তখন তাঁর এক পা ভাঙা আর দুই হাঁটু গুলিবিদ্ধ। দুঃসহ সেই স্মৃতির কথা বলতে গিয়ে সিএনএনকে ব্রেসনা বলেন, ‘মনে হচ্ছিল আমি মারা যাচ্ছি। হাসপাতালে প্রথম দিকের দিনগুলোতে মনে হয়নি আর বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিরতে পারব। মনে হয়েছে আমার জীবন এখানেই শেষ। আর কোনো আশা নেই।’
প্রায় এক বছর বিশ্ববিদ্যালয়ে যেতে পারেননি ব্রেসনা। হাঁটতে পারতেন না। হুইলচেয়ারে করে চলাফেরা করতে হতো। সিঁড়ি ভাঙতে হলে ভাইয়ের কোলে চেপে। শরীর যতটা না জখম হয়েছে, তার চেয়ে বেশি মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছিলেন ব্রেসনা।
এই বিশ্ববিদ্যালয়ে একজন ট্রাস্ট্রি ডালাসের এক চিকিৎসক, নাম জন আলেকজান্ডার। তিনি ব্রেসনার চিকিৎসাকাজে যুক্তরাষ্ট্রে আসা-যাওয়ার খরচ বহন করেন। ছয় মাস চিকিৎসা শেষে ব্রেসনা আফগানিস্তানে ফিরে আসেন। বিদেশে ব্রেসনা পাশে ছিলেন তাঁর বাগদত্তা। তিনি চেয়েছিলেন ব্রেসনাকে নিয়ে কানাডায় থিতু হতে। কিন্তু ব্রেসনা রাজি হননি। বলেন, ‘আমি বলেছি এটা ঠিক হবে না।’
বিশ্বে নারীদের মধ্যে আফগানিস্তানে নিরক্ষরতার হার সবচেয়ে বেশি। তবে এটাও ঠিক যে নিরাপত্তা হুমকি ও সামাজিক বিধিনিষেধ ভেঙে এগিয়ে যাওয়া ব্রেসনার মতো নারীর সংখ্যাও বাড়ছে।
ব্রেসনা বলেন, ‘প্রতিটি দিন আমার ভয়ে কাটত। বিশ্ববিদ্যালয়ের বাইরে আমি খুব ভয়ে থাকতাম। বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেতরটা বেশ নিরাপদ হলেও মনে হতো, আবারও যদি এমন হয়, কীভাবে বাঁচব, কী করব।’
ব্রেসনা এই সাফল্যের পর তাঁর সাক্ষাৎকার নেয় ওয়াশিংটন পোস্ট। এই সাক্ষাৎকারটি আফগান মানবাধিকারকর্মী সারাহ ফেতরাত তাঁর টুইটারে পোস্ট করেন। ছবিটি সেখান থেকে নেওয়া
ব্রেসনা এই সাফল্যের পর তাঁর সাক্ষাৎকার নেয় ওয়াশিংটন পোস্ট। এই সাক্ষাৎকারটি আফগান মানবাধিকারকর্মী সারাহ ফেতরাত তাঁর টুইটারে পোস্ট করেন।
ব্রেসনা এক অনুপ্রেরণার নাম
পরিবার, বন্ধু, শিক্ষক সবার অনুপ্রেরণায় আবারও ঘুরে দাঁড়ান ব্রেসনা। এখন তিনি অন্য নারী ও প্রতিবন্ধীদের জন্য এক সাহসের নাম। আর আফগানিস্তানের কাছে এক আশার প্রদীপ।
ব্রেসনা বলেন, ‘শিক্ষা আমাদের মৌলিক অধিকার। জন্মের সময়ই আমরা এই অধিকার নিয়ে আসি। এর জন্য আমাদের লড়াই করতে হবে। আমাদের নিজের প্রতি আস্থা রাখতে হবে। আর আমি মনে করি, নিজের প্রতি বিশ্বাস ও শিক্ষা হলো নিজের স্বপ্নকে সত্যি করার গুরুত্বপূর্ণ দুই উপাদান, বিশেষ করে প্রতিবন্ধীদের জন্য।’
ছোট্টবেলায় প্রতিনিয়ত হয়রানির শিকার হওয়ার ঘটনার কথা মনে করতে গিয়ে ব্রেসনা বলেন, ‘আমার অচল পা নিয়ে অনেক ছেলেমেয়ে খ্যাপাত। আমার খুব মন খারাপ হতো। হতাশা কাজ করত। মনে হতো, আমি অন্যদের মতো নই। কিন্তু আজ আমি আত্মবিশ্বাসী। কারণ, আমি শিক্ষিত।’
ব্রেসনা মনে করেন, তাঁর এই স্নাতক ডিগ্রি অর্জনের মধ্য দিয়ে পথচলা মাত্র শুরু হলো। দেশের বাইরে আইন বা মানবাধিকার বিষয়ে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি নিতে চান তিনি।
সনদ বিতরণ অনুষ্ঠানের পরপরই ব্রেসনার ছবি টুইটার ও ফেসবুকে ভাইরাল হয়ে পড়ে। শত শত মানুষ তাঁর ছবি শেয়ার করেন। অনেকে তাঁকে পাকিস্তানের মালালা ইউসুফজাইয়ের সঙ্গে তুলনা করেন। কাবুলের নারীবাদী ও মানবাধিকারকর্মী সারাহ ফেতরাত টুইটারে লিখেছেন, ব্রেসনা সাহস ও অনুপ্রেরণায় ভরপুর। তিনি নিশ্চিত আফগানিস্তানের মালালা। তাঁর অনেক ক্ষমতা। ব্রেসনাও সবার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন। বিভিন্ন টুইটের জবাবে তিনি ভবিষ্যতে এগিয়ে যেতে আরও উৎসাহ, সাহস চান সবার কাছে।
ব্রেসনা মনে করেন, আশাবাদী হওয়া খুব গুরুত্বপূর্ণ। বিশ্বাস করতে হবে, যা কিছু খারাপ, তা একদিন শেষ হবে। আর শুভ কিছুর উদয় হবে।