নৌপথে নিরাপত্তার দাবিতে উপকুলীয় ১৬টি সংগঠনের সংবাদ সম্মেলনে বক্তারা
অনিয়ম আর অব্যবস্থাপনাই নৌ-দুর্ঘটনার মূল কারণ, দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা-কর্মচারী ও
দোষী মালিকদের বিরুদ্ধে কঠিন শাস্তির আইন ও তার কার্যকারিতা চাই
ঢাকা, ৭ আগস্ট ২০১৪। সাম্প্রতিক লঞ্চ দুর্ঘটনা নিয়ে উপকূলীয় এলাকায় কর্মরত ১৬ টি সংগঠন আজ জাতীয় প্রেসক্লাবে ‘অনিয়ম আর অব্যবস্থাপনাই নৌ-দুর্ঘটনার অন্যতম কারণ: নৌ-যানের নকশা অনুমোদন এবং তদারকি ব্যবস্থার বিকেন্দ্রীকরণ প্রয়োজন’ শীর্ষক এক সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করে। সংবাদ সম্মেলনে অনিয়ম আর অব্যবস্থাপনাকে নৌ দুর্ঘটনার মূল কারণ হিসেবে চিহ্নিত করে দেশের নৌ-পথগুলোকে নিরাপদ ও ঝুঁকিমুক্ত রাখার জন্য দায়িত্বে অবহেলাকারী, দুর্নীতিবাজ সরকারি কর্মচারী-কর্মকর্তা এবং দোষী মালিকদের বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি জানানো হয়। সংবাদ সম্মেলনটি যৌথভাবে আয়োজন করে অর্পন, আকাশ, উদয়ন বাংলাদেশ, নিরাপদ নৌপথ বাস্তবায়ন আন্দোলন, এনবিএস, এসডিও, প্রান্তজন, শাপলা ফুল, প্রাণ, ডোক্যাপ, গ্রাউস, পালস-বাংলাদেশ, রয়েল বেঙ্গল ফাউন্ডেশন, সমাজ, সিডিপি ও কোস্ট ট্রাস্ট।
কোস্ট ট্রাস্টের মোস্তফা কামাল আকন্দের সঞ্চালনায় অনুষ্ঠিত সংবাদ সম্মেলনে আয়োজকদের পক্ষ থেকে মুল বক্তব্য উপস্থাপন করেন একই সংস্থার মো. মজিবুল হক মনির। এতে আরও বক্তব্য রাখেন নিরাপদ নৌপথ বাস্তবায়ন আন্দোলনের সদস্য সচিব আমিনুর রসূল বাবুল। সংবাদ সম্মেলনে আরও উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মো. মোজাম্মেল হক চৌধুরী
মো. মজিবুল হক মনির বলেন, পিনাক-৬ ডুবে যাওয়া কোনও দুর্ঘটনা নয়। প্রকাশ্য অনিয়ম আর অব্যবস্থাপনার পরিণতিকে কোনভাবেই ‘দুর্ঘটনা’ বলা যায় না। অনিয়ম-অব্যবস্থাপনা-অবহেলার একটি করুণ পরিণতি পিনাক-৬ নামের লঞ্চটির এই ডুবে যাওয়া। পিনাক-৬ লঞ্চের চলাচল অনুমোদনের মেয়াদ শেষ হয়ে গিয়েছিল, এর যাত্রী ধারণক্ষমতা ছিল ৮৫ অথচ বহন করছিল তিন শতাধিক। পদ্মায় ২ নম্বর সতর্কসংকেত দেখানো অবস্থায় ৬৫ ফুটের কম দৈর্র্ঘ্যরে লঞ্চ চলাচল নিষিদ্ধ ছিল। কিন্তু পিনাকের দৈর্ঘ্য ছিল ৫২ ফুট। অর্থাৎ পিনাক-৬ এর চলাচল, ডুবে যাওয়া এবং অনকাক্সিক্ষত প্রাণহানি প্রমাণ করে পুরো নৌ পরিবহন ব্যবস্থাপনাটাই আসলে এখানে ছিল অকার্যকর। তিনি আরও বলেন, প্রত্যেকটা দুর্ঘটনার পরই তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। মনে হয় যেন তদন্ত কমিটি গঠন করার মাধ্যমেই সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ তার দায়িত্ব শেষ করতে চায়। কারণ স্বাধীনতার পর এখন পর্যন্ত প্রায় পাঁচ শতাধিক তদন্ত কমিটি গঠন করা হলেও প্রকাশ করা হয়েছে মাত্র তিনটি তদন্ত প্রতিবেদন। অনেক তদন্ত কমিটি তাদের প্রতিবেদন জমাও দেয় না। দুর্ঘটনার তদন্তে প্রায়ই উঠে আসে মালিক-চালক বা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের অবহেলা-গাফিলতির কথা। কিছু কিছু মামলাও হয়, কিন্তু কোনও শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি বললেই চলে।
আমিনুর রসূল বাবুল বলেন, যারা ভুল-ত্রুটিপূর্ণ নকশার লঞ্চ চলাচলে সহায়তা করে সেইসব দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে। তিনি দেশে এই মুহুর্তে চলমান নৌযানের সংখ্যা জানতে নৌশুমারি করার প্রয়োজনীয়তার কথাও বলেন। তিনি বলেন, প্রচ- ¯্রােতের মধ্যে ডুবে যাওয়া লঞ্চটি ৩ ঘন্টা পরেও ডুবে যাওয়ার স্থানে থাকার কথা নয়, অথচ লঞ্চটি খোঁজার কাজটি শুরু করা হলো সেখানেই। এটা আসলে এক ধরনের আই ওয়াশ। যাত্রীর সংখ্যা কম দেখানোর জন্য কর্তৃপক্ষ ইচ্ছে করেই ভুল জায়গায় লঞ্চ খুঁজেন বলে তিনি অভিমত প্রকাশ করেন।
মোস্তফা কামাল আকন্দ বলেন, নৌ দুর্ঘটনা প্রতিরোধে এবং একটি দুর্ঘটনা ঘটলে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য সরকারের প্রস্তুতির অভাব রয়েছে। দেশে ডুবুরি আছেন মাত্র ২৫ জন, তাও আবার তারা পূর্ণকালীন নন। এধরনের দুর্যোগ মোকাবেলায় দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা বিভাগকে সম্পৃক্ত করে, তাদের স্বেচ্ছাসেবকদের সহযোগিতা নেওয়া প্রযোজন। তিনি আরও বলেন, নকশা অনুমোদন প্রক্রিয়াকে কেন্দ্রীভূত করে রাখা হয়েছে দুর্নীতিবাজদের ঘুষ বাণিজ্য নিশ্চিত করার জন্যই। কারণ এটা বিকেন্দ্রীকরণ করা হলে তাদের ঘুষের আয়ে ভাটা পড়বে। তিনি আরও বলেন, লঞ্চ মালিকদের বিরুদ্ধে তেমন কোনও ব্যবস্থা নেওয়া যাচ্ছে না, কারণ তারা প্রভাবশালী রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে জড়িত।
সংবাদ সম্মেলন থেকে কয়েকটি সুনির্দিষ্ট দাবি পেশ করা হয়, সেগুলো হলো: (১) নকশা প্রণয়নকারী ও ত্রুটিপূর্ণ নকশার লঞ্চ নির্মাণকারীকে আইনের আওতায় আনতে হবে, দায়িত্বে অবহেলাকারীদের জন্য কঠোর শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। (২) ফিটনেসবিহীন নৌযান চলাচল বন্ধ করতে হবে। দক্ষ চালক নিশ্চিত করতে হবে। কোন লঞ্চকে বিপজ্জনক মনে হলে সেই লঞ্চকে আটক করার ক্ষমতা সমুদ্র পরিবহণ অধিদপ্তর ও বিআইডাব্লিউটিএ-কে প্রদান করতে হবে। (৩) নকশা প্রণয়ন পদ্ধতি জেলা-উপজেলা পর্যন্ত বিকেন্দ্রীকরণ করতে হবে। (৪) মেরিন ম্যাজিস্ট্র্রেট কোর্টে পুলিশ ফোর্স মঞ্জুর করতে হবে। (৫) নৌ-দুর্ঘটনায় নিহত ও আহতদের পরিবারকে মাথাপিছু ক্ষতিপূরণ দানের বিধান করতে হবে। (৬) লঞ্চ যাত্রার প্রাক্কালে যাত্রীদের তালিকা প্রণয়ন বাধ্যতামূলক করতে হবে।(৭) ঈদ ও পুজোর ছুটিতে এবং কালবৈশাখীর সময়ে লঞ্চ ঘাটে অতিরিক্ত পরিদর্শনকারী ম্যাজিস্ট্রেট ও পুলিশ নিয়োগ করতে হবে।(৮) সংশ্লিষ্ট সকল কর্তৃপক্ষের মধ্যে সু-সমন্বয় নিশ্চিত করতে হবে।
বার্তা প্রেরক: মোস্তফা কামাল আকন্দ,