ঢাকার অদূরে দক্ষিণ কেরানীগঞ্জের আবদুল্লাহপুর এলাকার একটি বাসায় হাত-পা ও মুখ বাঁধা চার জনের অর্ধগলিত লাশ উদ্ধার করেছে পুলিশ। এদের মধ্যে ছয় ও তিন বছরের দুই শিশু এবং তাদের বাবা (৩৫) ও মা (৩০) রয়েছেন। তাদের কারও পরিচয় শনাক্ত করতে পারেনি পুলিশ। ধারণা করা হচ্ছে, অজ্ঞাত দুর্বৃত্তরা শ্বাসরোধে তাদের হত্যা করেছে। দুই শিশুসহ তাদের পিতাার লাশ মেঝেতে ও মায়ের লাশ তোষক দিয়ে ঢেকে রাখা ছিল। পুলিশ ওই বাসা থেকে ইয়াবা সেবনের কিছু উপকরণ উদ্ধার করেছে। ময়নাতদন্তের জন্য লাশগুলো স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের (মিটফোর্ড) মর্গে পাঠিয়েছে। পুলিশ ও প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, দক্ষিণ কেরানীগঞ্জের আবদুল্লাহপুর কলাকান্দি কদমপুরের সৌদিপ্রবাসী সামছুল ইসলামের ছয় তলা বাড়ির দ্বিতীয় তলার একটি ফ্ল্যাট দুই মাস আগে এক পরিবার ভাড়া নেয়। গত কয়েকদিন বাসার গত মাসের ভাড়া নেয়ার জন্য কেয়ারটেকার সোহেল তাদের খোঁজ করতে থাকেন। কিন্তু কয়েক দিন ধরেই বাসাটি বাইরে থেকে তালাবদ্ধ অবস্থায় ছিল। গতকাল সকালে সোহেল আবার ওই বাসায় গেলে তালা খোলা এবং তালার সঙ্গে চাবি ঝুলে থাকতে দেখেন। এছাড়া বাইরে থেকে দরজার ছিটকিনি লাগানো ছিল। কেয়ারটেকার সোহেল দরজা খুলে ভেতরে কক্ষে হাত-পা বাঁধা একাধিক লাশ দেখে দৌড়ে নিচে নামেন। তার চিৎকারে আশপাশের লোকজন জড়ো হয়। স্থানীয় ৮ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য বাবুল দেওয়ানের নেতৃত্বে স্থানীয় লোকজন ওই বাসায় গিয়ে খাটের নিচে লাশ পড়ে থাকতে দেখে। পরে তারা খাটটি সরিয়ে একাধিক লাশ দেখে থানায় খবর দেন। খবর পেয়ে থানা পুলিশের পাশাপাশি সিআইডির ক্রাইম সিন, জেলা গোয়েন্দা সদস্যসহ র্যাব-পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা ঘটনাস্থলে যান। দীর্ঘ সময় নিয়ে সিআইডির ক্রাইম সিনের সদস্যরা ওই বাসা থেকে বিভিন্ন আলামত ও হাত-পায়ের ছাপ সংগ্রহ করে। বিকালে ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন ঢাকা জেলার এসপি হাবিবুর রহমান। তিনি বলেন, এটি পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড। দুই-তিন দিন আগে তাদের শ্বাসরোধে হত্যা করা হয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। লাশগুলোতে পচন ধরেছে। সবার হাত-পা ও মুখ কাপড় দিয়ে বাঁধা ছিল। তিনি বলেন, পরিচয় শনাক্ত করা না গেলেও সবাই এক পরিবারের বলে ধারণা করা হচ্ছে। বিষয়টি অত্যন্ত স্পর্শকাতর। অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে খতিয়ে দেখা হচ্ছে। এরই মধ্যে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য বাড়ির কেয়ারটেকার সোহেল ও আক্কাসকে আটক করা হয়েছে। আক্কাসের মাধ্যমে ওই পরিবারটি বাসা ভাড়া নিয়েছিল।
পুলিশের হাতে আটক হওয়ার আগে কেয়ারটেকার সোহেল জানান, স্থানীয় আক্কাসের মাধ্যমে তিন মাস আগে ওই বাসাটি রফিক নামে এক ব্যক্তি ৪৫০০ টাকায় ভাড়া নেন। আক্কাস ও রফিক দু’জনই সিএনজি চালক। রফিক ও তার স্ত্রী এক মাস থাকার পর রফিকের এক আত্মীয় পরিচয় দিয়ে ওই বাসায় চার জনের এই পরিবারটি ওঠে। তবে গত মাসের এবং চলতি মাসের কোন ভাড়া তারা দেয়নি। সোহেল জানান, কয়েক দিন ধরে তিনি ভাড়ার জন্য বারবার ওই বাসার লোকজনের খোঁজে আসতেন। কিন্তু বরাবরই বাসা তালাবদ্ধ দেখেন। গতকাল সকাল ৯টার দিকে হঠাৎ তালা খোলা এবং তালার সঙ্গে চাবি ঝুলতে দেখেন। পরে ছিটকিনি খুলে ঘরে ঢুকে সবার লাশ দেখতে পান তিনি। সোহেল বলেন, বাসার ভাড়াটিয়া পুরুষ লোকটির নাম মনে নেই। কিন্তু তিনি কাঁচা তরকারির ব্যবসা করতেন বলে জানিয়েছিলেন। এছাড়া তার বাড়ি বিক্রমপুরে- এইটুকু তথ্য জানা ছিল তার।
গতকাল দুপুরে সরজমিনে ঘটনাস্থলে গিয়ে দেখা যায়, কদমপুরের ছয়তলা ওই ভবনটির সামনে শ’ শ’ মানুষের ভিড়। চার হত্যাকাণ্ডের খবর শুনে আশপাশের এলাকা থেকে উৎসুক মানুষ ছুটে এসেছেন। তাদের সামাল দিতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে হিমশিম খেতে হচ্ছে। আগত সবার চোখ-মুখে উৎকণ্ঠার ছাপ। ছয় তলা ভবনের দ্বিতীয় তলার ডান পাশের ওই ফ্ল্যাটটিতে ঢুকলেই ছোট্ট বসার ও খাবারের জায়গা (ডাইনিং কাম ড্রয়িং রুম)। পাশাপাশি দু’টি কক্ষ। একদিকে একটি বাথরুম ও রান্নাঘর। মূল দরজা বরাবর একটি কক্ষে চারটি লাশ পড়ে আছে। পাশে একটি কাঠের চৌকি দেয়ালের সঙ্গে হেলান দিয়ে রাখা। মেঝেতে আনুমানিক ৩৫-৪০ বছর বয়সের পুরুষের নগ্ন দেহ। পরনের লুঙ্গিটা একটু দূরে পড়ে আছে। লাল একটি শাড়ি দিয়ে হাত বাঁধা। মুখ ও পা বাঁধা নীল চেকের আরেকটি কাপড় দিয়ে। তার সামনের দিকে আনুমানিক ৫-৬ বছরের ছেলে শিশুর লাশ। পরনে হাফ প্যান্ট ও ছাপার শার্ট। পিতার হাত বাঁধা শাড়ির অপর অংশ দিয়ে শিশুটিরও হাত বাঁধা হয়েছে। মুখ ও পা বাঁধা অন্য কাপড় দিয়ে। কাত হয়ে শোয়া পুরুষটির পেছনের দিকে বছর আড়ই-তিনেকের মেয়ে শিশুর লাশ। তার পরনে কেবল একটি হাফ প্যান্ট। খালি গা। আর দেয়ালের কাছে তোষক ও কাঁথা বালিশের ওপর উপুড় হয়ে পড়ে আছেন ২৫-৩০ বছর বয়সী এক মহিলা। তার পরনে ছাপা শাড়ি। তারও হাত-পা-মুখ বাঁধা। স্থানীয়রা জানান, দেয়ালে ঠেস দিয়ে রাখা চৌকিটির নিচে মহিলার লাশ তোষক দিয়ে ঢাকা ছিল। আর অন্যদের লাশ ছিল চৌকির পাশে। স্থানীয়রা চৌকিটি সরিয়ে রেখেছে। দুই কক্ষের ফ্ল্যাটটি ঘুরে দেখা যায়, একটি আলনা ও আর ওই চৌকিটি ছাড়া আর কোন আসবাবপত্র নেই ওই বাসায়। একটি ব্যাগে কিছু পুরনো কাপড়। একটি কার্টুন পড়ে আছে মেঝেতে। সবই এলোমেলো। লাশের পাশে একটি এনার্জি ড্রিংকের খালি ক্যান পড়ে ছিল। বেসিনেও আরেকটি খালি ক্যান। রান্না ঘর ফাঁকা। গত কয়েক দিনে কোন কিছু রান্না হয়নি বোঝা যাচ্ছিল। আর পাশের কক্ষের মেঝেতে একটি কার্টুন কভার বিছানো। সেখান থেকে পুলিশ বিশ টাকার নোট দিয়ে বানানো দু’টি সরু পাইপ উদ্ধার করেছে। এছাড়া দু’টি মোমবাতি ও বাথরুম থেকে ফয়েল পেপার উদ্ধার করা হয়েছে। পুলিশ কর্মকর্তারা বলছিলেন, এসব দিয়ে ইয়াবা খাওয়া হয়। ধারণা করা হচ্ছে, খুনিরা ওই বাসায় আগে থেকেই যাতায়াত করতো। তারা নিয়মিত পাশের রুমের কার্টুন পাতা বিছানায় বসে ইয়াবা সেবন করতো। কেয়ারটেকার সোহেল জানিয়েছে, চার সদস্যের ওই পরিবারের সঙ্গে দুই ব্যক্তিও ওই বাসায় মাঝেমধ্যে থাকতো। পুলিশের ধারণা, অজ্ঞাত ওই দুই ব্যক্তি এই হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত থাকতে পারে।
কেরানীগঞ্জ থানার এসআই মনিরুজ্জামান জানান, ওই বাসা থেকে কয়েকটি জাতীয় পরিচয়পত্র ও একটি ড্রাইভিং লাইসেন্স ও একটি সিমবিহীন ফোনসেট উদ্ধার করা হয়েছে। জাতীয় পরিচয়পত্রের একটি আগের ভাড়াটিয়া রফিকের। আর অপর একটি জাতীয় পরিচয়পত্র মমিনুল ইসলামের। তার গ্রামের ঠিকানায় লেখা ডোমার, নীলফামারী। এছাড়া ড্রাইভিং লাইসেন্সটিতে সাজু আহমেদ, পিতা কবির উল্লাহ, গ্রাম জোনপুর, তালাপুর, কেরানীগঞ্জ লেখা রয়েছে। গোয়েন্দা পুলিশের একটি সূত্র জানিয়েছে, তারা খোঁজ নিয়ে জানতে পেরেছেন সাজু আগে সিএনজি চালক ছিল। এর পাশাপাশি চুরি ডাকাতি ও ইয়াবার ব্যবস করতো। এ কারণে কেরানীগঞ্জের জোনপুর এলাকা থেকে স্থানীয়রা তাকে কয়েক বছর আগে বিতাড়িত করে। মমিনুলের বিস্তারিত খোঁজ পাওয়া যায়নি। ওই সূত্র জানায়, তারা ধারণা করছেন, সিএনজি চুরি, ছিনতাই-ডাকাতি ও মাদক ব্যবসার একটি সিন্ডিকেটের সদস্যরা ওই বাসায় যাতায়াত করতো। চুরি-ছিনতাই-ডাকাতির মালামাল তারা ওই বাসায় রাখতো। এ সবের ভাগাভাগির জের ধরে হত্যাকাণ্ডটি ঘটেছে।
পাশের ফ্লাটের বাসিন্দা হাসিনা বেগম ও তার ভাইঝি পাপিয়া সুলতানা জানান, পাশের ফ্ল্যাটে নতুন ভাড়াটিয়া উঠলেও তাদের সঙ্গে কখনও পরিচয় হয়নি। বেশির ভাগ সময় ফ্ল্যাটটিতে তালা ঝুলতে দেখেছেন তারা। গত দুই একদিনের মধ্যে কোন চেঁচামেচি বা চিৎকারও শুনতে পাননি তারা। ভবনের নিচে দু’টি মুদি ও চায়ের দোকান রয়েছে। এর একটির মালিক দুলাল জানান, দুই মাস আগে যখন ভাড়াটিয়ারা ওই বাসায় ওঠে তখন তারা একটি মিনি ট্রাকে করে মালামাল এনেছিল। এ সময় তাদের সঙ্গে বোরকা পরা দুই মহিলাও ছিল। সঙ্গে ছিল সুঠামদেহী দুই পুরুষও। এরপর গত দুই মাসে তাদের আরেকবার দেখেছিলেন। তারা কখনও তার দোকান থেকে মালামাল কেনেনি। পাশের দোকানদার নাজমা বেগম জানান, এই দুই মাসে একদিন একটি শিশু একবার দোকান থেকে একটা চিপস নিয়ে গেছে। আর কখনও তাদের দেখেননি বলে জানান। কেরানীগঞ্জ সার্কেলের সহকারী পুলিশ সুপার (এএসপি) কাজী মাকসুদা লিমা জানান, আমরা কিছু তথ্য পেয়েছি। সেগুলো যাচাই-বাছাই করা হচ্ছে। আশা করি শিগগিরই এ খুনের ঘটনার রহস্য উদঘাটন করা সম্ভব হবে।