গাড়িচালক শাহ আলমের স্ত্রী শান্তার সঙ্গে পরকীয়ায় জড়িয়েছিল শেরেবাংলা নগর থানার এসআই আনোয়ার। শান্তাকে দিয়ে স্বামী শাহ আলমের বিরুদ্ধে নারী নির্যাতনের একটি মামলাও করিয়েছিল বছর খানেক আগে। স্বামীর কাছ থেকে ভাগিয়ে তাকে নিজের রক্ষিতা বানিয়ে রেখেছিল কেরানীগঞ্জের একটি ফ্ল্যাটে। নাছোড়বান্দা শাহ আলম মাস দেড়েক আগে স্ত্রী শান্তার খোঁজ পায়। চেষ্টা করে স্ত্রী ও আড়াই বছরের কন্যা আফরীনকে ফিরিয়ে আনার। এ নিয়ে কেরানীগঞ্জের আরশিনগরে কয়েক দফা সালিশ-বৈঠকও হয়। কিন্তু এতে বাধা হয়ে দাঁড়ায় এসআই আনোয়ার। উপায়ন্তর না পেয়ে বিষয়টি ওই পুলিশ কর্মকর্তার স্ত্রীকে জানানোর পরিকল্পনা করে শাহ আলম। এই তথ্য জানতে পেরে এসআই আনোয়ার গত রোববার রাত ৯টার দিকে কৌশলে শাহ আলমকে ডেকে নেয় মোহাম্মদপুরের কৃষি মার্কেট এলাকায়। সেখান থেকে চোখ বেঁধে ও হ্যান্ডকাফ পরিয়ে একটি মাইক্রোবাসে তুলে নিয়ে যায় তাকে। মধ্যরাতে আগারগাঁওয়ের তালতলায় শাহ আলমের দুই পায়ে অস্ত্র ঠেকিয়ে গুলি করে। ঊর্ধ্বতন পুলিশ কর্মকর্তাদের জানায় শাহ আলম একজন ছিনতাইকারী। বন্দুকযুদ্ধের সময় শাহ আলম গুলিবিদ্ধ হয়েছে। তার কাছ থেকে একটি বিদেশী পিস্তল ও তিন রাউন্ড গুলি উদ্ধারেরও মিথ্যা গল্প সাজায় এসআই আনোয়ার। কিন্তু শেষ রক্ষা হয়নি তার। পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা গোপনে তদন্ত করে জানতে পারেন পুরো বিষয়টি সাজানো। এ কারণে গতকাল এসআই আনোয়ারকে শেরেবাংলানগর থানা থেকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। এস আইয়ের পক্ষ নিয়ে মিথ্যা তথ্য দেয়া ও দায়িত্বে অবহেলার কারণে প্রত্যাহার করা হয় ওসি আবদুল মমিনকে। এর আগে গুলিবিদ্ধ শাহ আলমের বড় ভাই গোলাম মোস্তফা বাদী হয়ে আনোয়ারের বিরুদ্ধে শেরেবাংলা নগর থানায় একটি হত্যাচেষ্টা মামলা (নং ২০) দায়ের করেছেন। গতকালই মামলাটি থানা পুলিশের কাছ থেকে মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে।
জাতীয় অর্থপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন কেন্দ্রের (পঙ্গু হাসপাতাল) ওটি অবজারভেশন ওয়ার্ডে চিকিৎসাধীন শাহ আলম জানান, বছর দেড়েক আগে তিনি মোহাম্মদপুর থানার সিভিল টিমের গাড়ি চালাতেন। এসআই আনোয়ার ছিল সিভিল টিমের দায়িত্বে। সেই সুবাদে এসআই আনোয়ার তার বাঁশবাড়ির বাসায় যাতায়াত করতো। সে সময় তিনি জানতে পারেন তার স্ত্রীর সঙ্গে এসআই আনোয়ারের অবৈধ সম্পর্ক গড়ে উঠেছে। এ নিয়ে বিরোধের জের ধরে স্ত্রী তার কাছ থেকে চলে যায়। এমনকি মোহাম্মদপুর থানায় একটি নারী নির্যাতনের মামলাও করে। এ মামলায় পুলিশ তাকে গ্রেপ্তার করে জেলহাজতে পাঠালে শান্তা তার একটি সিএনজি অটোরিকশা তিন লাখ টাকায় বিক্রি করে ও বাসার জিনিসপত্র নিয়ে চলে যায়। কয়েকদিন পর সে জেল থেকে জামিনে বেরিয়ে এসে শ্বশুরবাড়িতে স্ত্রী-সন্তানের খোঁজ করে। কিন্তু তারা খোঁজ দেয়নি। শাহ আলম জানান, মাস দেড়েক আগে তিনি জানতে পারেন তার স্ত্রী কেরানীগঞ্জের আরশিনগরের একটি বাসায় থাকে। সে খোঁজ করে ওই বাসাটি বের করে। কয়েকদিন ঘুরে জানতে পারে ওই বাসায় প্রতিদিন এস আই আনোয়ার যাতায়াত করে। ওই বাসার পাশেই তার শ্বশুর-শাশুড়িও থাকে। পরে সে স্থানীয় মাতব্বরদের তার স্ত্রীর পালিয়ে থাকা ও পুলিশ কর্মকর্তার যাতায়াতের বিষয়টি জানায়। এ নিয়ে স্থানীয়ভাবে কয়েক দফা সালিশ-বৈঠকও হয়। কিন্তু প্রথম দিকে শাহ আলমের শ্বশুর-শাশুড়ি তাকে মেয়ের জামাই বলে অস্বীকার করে। এক পর্যায়ে সালিশে কোরান ছুঁয়ে বলতে বলা হলে তারা বিষয়টি স্বীকার করে। গত ১৭ই অক্টোবর আবারও বৈঠকে বসার সিদ্ধান্ত হয়। কিন্তু এদিন আলমের শ্বশুর-শাশুড়ি সালিশে হাজির হয়নি। শাহ আলম জানতে পারে এস আই আনোয়ার তার শ্বশুর-শাশুড়িকে বৈঠকে বসতে বাধা দিচ্ছে। পরে সে সিরাজ নামে এসআই আনোয়ারের এক পরিচিতকে বিষয়টি খুলে বলে। সে বিষয়টি এসআই আনোয়ারের স্ত্রীকে জানানোর পরিকল্পনা করে। কিন্তু সিরাজ তাকে আনোয়ারের বাসা দেখিয়ে দেয়ার কথা বললেও বিষয়টি আনোয়ারের কাছে ফাঁস করে দেয়। এতে আনোয়ার ক্ষিপ্ত হয়ে গত রোববার রাতে সিরাজের মাধ্যমে শাহ আলমকে কৃষি মার্কেটের সামনে ডেকে নেয়। শাহ আলম জানায় কৃষি মার্কেটের সামনে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সিভিল পোশাকে কয়েকজন তাকে জোর করে একটি মাইক্রোবাসে তুলে ফেলে। তার হাতে হাতকড়া ও চোখ-মুখ বেঁধে ফেলে। তাকে নিয়ে গাড়িতে ঘণ্টা খানেক ঘোরানো হয়। রাত ১২টার দিকে তালতলা এলাকায় জোর করে মাটিতে শুইয়ে রেখে প্রথমে ডান পায়ে অস্ত্র ঠেকিয়ে গুলি করে। পরে গুলি করে বাম পায়ে। তারপর তাকে ভর্তি করা হয় পঙ্গু হাসপাতালে।
ক্রসফায়ারের নামে হত্যার পরিকল্পনা ছিল: হাসপাতালে আহত শাহ আলম জানান, তাকে তালতলা এলাকায় নিয়ে এসআই আনোয়ার তাকে বলে, ‘আজ তোর শেষ দিন। কি খেতে চায় বল?’ শাহ আলম প্রত্যুত্তরে জানায় কিছুই খাওয়ার ইচ্ছা নেই তার। এ সময় তার মুখ খুলে দিয়েছিল। এরপর আবার মুখ বেঁধে ফেলা হয়। তার ভয় হয়েছিল তাকে হয়তো মেরে ফেলা হবে। গলা শুকিয়ে যায়। কিন্তু মুখ বাঁধা থাকায় কিছু বলতে পারছিল না সে। তবে মনে মনে আল্লাহকে ডাকতে থাকে। কিছুক্ষণ পর তাকে জোর করে মাটিতে শোয়ানো হয়। এরপর প্রথমে ডান পায়ে ও পরে বাম পায়ে গুলি করা হয়। গুলির পরপরই অচেতন হয়ে যায় সে। হাসপাতালে নেয়ার পর জ্ঞান ফেরে তার। শেরেবাংলানগর থানার একটি সূত্র জানায়, এসআই আনোয়ার থানার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের মিথ্যা তথ্য দিয়েছিল। বলেছিল অস্ত্রসহ একজন ছিনতাই ধরেছে। তাকে ক্রসফায়ারে মেরে দেয়ার পরিকল্পনাও করেছিল। কিন্তু সঙ্গীয় ও থানার ওসি আবদুল মমিন তাকে মেরে ফেলতে নিষেধ করে। বলে, এটা সামাল দেয়া কঠিন হবে। পরে এসআই আনোয়ার কথিত ক্রসফায়ারে শাহ আলমকে হত্যার পরিকল্পনা থেকে সরে আসে। নিজেই অবৈধ একটি অস্ত্র ও তিন রাউন্ড গুলি সংগ্রহ করে ঘটনাস্থল থেকে উদ্ধার দেখায়।
যেভাবে সত্য বেরিয়ে আসে: পুলিশের তেজগাঁও জোনের একটি সূত্র জানায়, কথিত বন্দুকযুদ্ধের পরপরই তেজগাঁও জোনের ডিসি বিপ্লব কুমার সরকারকে বিষয়টি জানানো হয়। ডিসি আহত শাহ আলমকে হাসপাতালে ভর্তি ও আইনগত ব্যবস্থা নেয়ার নির্দেশ দেন। কিন্তু ঘটনার পরদিন ডিসি জানতে পারেন বন্দুকযুদ্ধের ঘটনাটি সাজানো। পরে তিনি এসআই আনোয়ারকে নিজের কার্যালয়ে ডেকে পাঠান। এসআইয়ের কথাবার্তায় তার সন্দেহ হয়। বিষয়টি নিয়ে শেরেবাংলা নগর থানার ওসি আবদুল মমিনের সঙ্গেও কথা বলেন। কিন্তু ওসি-ও আনোয়ারের পক্ষে মিথ্যা তথ্য দেন। তিনি গোপনে বিষয়টি অনুসন্ধান করে জানতে পারেন পুরো বিষয়টি সাজানো। পরে মঙ্গলবার তেজগাঁও জোনের এডিসিকে প্রধান করে আনুষ্ঠানিক একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেন। প্রাথমিক তদন্তে ঘটনাটি সাজানোর প্রমাণ পাওয়ায় গতকাল এসআই আনোয়ারকে গ্রেপ্তারের নির্দেশ দেন। দায়িত্বে অবহেলা ও এসআই আনোয়ারের পক্ষ নিয়ে মিথ্যা তথ্য দেয়ার জন্য ডিএমপি কমিশনারের কাছে ওসিকে প্রত্যাহারের সুপারিশ করেন। একই সঙ্গে শাহ আলমের ভাই গোলাম মোস্তফাকে ডেকে এসআই আনোয়ারের বিরুদ্ধে হত্যাচেষ্টা মামলা দায়ের করার জন্য বলেন। পুলিশের তেজগাঁও জোনের উপকমিশনার বিপ্লব কুমার সরকার বলেন, আমার এলাকায় পুলিশ কোন অন্যায় করলে তাদের ছাড় নেই। আমি যখনই জানতে পারি যে ঘটনাটি সাজানো তখনই এসআইকে গ্রেপ্তারের নির্দেশ দেই।
মামলা ডিবিতে হস্তান্তর: পরকীয়ার জের ধরে নিরীহ গাড়িচালক শাহ আলমকে কথিত বন্দুকযুদ্ধের মাধ্যমে সন্ত্রাসী সাজানোর চেষ্টার ঘটনায় দায়েরকৃত মামলাটি গতকালই মহানগর গোয়েন্দা পুলিশে স্থানান্তর করা হয়েছে। মামলা দায়েরের পরপরই ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের নির্দেশে মামলাটি ডিবিতে স্থানান্তরের নির্দেশ দেয়া হয়। বিকালে গোয়েন্দা পুলিশের (পশ্চিম) সহকারী কমিশনার (এসি) হাফিজুর রহমানের নেতৃত্বে একটি দল শেরেবাংলা নগর থানায় যায়। সন্ধ্যায় সেখান থেকে একটি মাইক্রোবাসে করে এসআই আনোয়ারকে নিয়ে যায় তারা। এর আগে বিকাল ৩টার দিকে এসআই আনোয়ারকে গ্রেপ্তারের পর তাকে থানার মহিলা হাজতখানায় রাখা হয়। হাজতখানার ভেতরে এসআই আনোয়ার একটির পর একটি সিগারেট টানছিলেন। বিকালে থানায় আসে আনোয়ারের স্ত্রী ও শ্বশুর। তারা হাজতখানার পাশে সেরেস্তাদারের রুমে বসেছিলেন। সেখানে বিষয়টি কিভাবে সমাধান করা যায় তা নিয়ে কথা বলছিল অন্য পুলিশ কর্মকর্তাদের। কিছুক্ষণ পরপর তারা এসআই আনোয়ারের সঙ্গেও কথা বলে। আনোয়ারের শ্বশুর জানায়, তুমি চিন্তা করো না। যত টাকা লাগে আমি খরচ করবো। আনোয়ার তার স্ত্রীকে বলে, বাসা থেকে মূল্যবান জিনিসপত্র, ব্যাংকের চেক বই সরিয়ে রাখতে।
শান্তাকে রক্ষিতা হিসেবে ব্যবহার করতো আনোয়ার: পরকীয়ায় জড়িয়ে শাহ আলমের স্ত্রী শান্তাকে ভাগিয়ে কেরানীগঞ্জের আরশিনগরের একটি ফ্ল্যাটে রাখে এসআই আনোয়ার। শান্তাকে সে রক্ষিতা হিসেবে ব্যবহার করতো। সপ্তাহে ৪-৫ দিন সে ওই ফ্ল্যাটে যাতায়াত করতো। তবে কখনও ৪-৫ ঘণ্টার বেশি থাকতো না। ওই বাসার কেয়ারটেকার মোফাজ্জল জানায়, মাস দুয়েক আগে আনোয়ার নিজেকে মোহাম্মদপুরের মোটর পার্টস ব্যবসায়ী পরিচয়ে ফ্ল্যাটটি ৮ হাজার টাকায় ভাড়া নেয়। অগ্রিম হিসেবে দেয় ১৫ হাজার টাকা। তারা মনে করেছিলেন স্বামী-স্ত্রী। কিন্তু যাতায়াত বাসায় অল্প সময় থাকা নিয়ে তারা সন্দেহ করেছিলেন। পরে শান্তার বাবা-মা এসেও তাদের মেয়ে ও মেয়ের জামাই বলে পরিচয় করিয়ে দেয়। সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র জানায়, এসআই আনোয়ার ২০০৭ সালে পুলিশে এসআই হিসেবে যোগদান করে। তার গ্রামের বাড়ি শরীয়তপুরে। পুলিশে যোগদানের পর থেকেই সে অবৈধভাবে অর্থ উপার্জনের জন্য বেপরোয়া হয়ে ওঠে। বছর খানেক আগে সে শেরেবাংলা নগর থানায় বদলি হয়। এর আগে মোহাম্মদপুর থানায় ৩-৪ বছর দায়িত্ব পালন করে। মামলার তদন্তের নামে ও অন্যান্যভাবে প্রতি মাসে বিপুল পরিমাণ অর্থ আয় করতো সে। এ থেকে প্রতিমাসে রক্ষিতা হিসেবে শান্তার জন্য ২৫-৩০ হাজার টাকা খরচ করতো।