এক দশকের বেশি সময় ধরে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে তুরস্কের ক্ষমতায় থাকা এরদোগান সরকারকে যেন লাল কার্ড দেখিয়েছে দেশটির ভোটাররা। গত রোববার তুরস্কের পার্লামেন্ট নির্বাচনে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা হারিয়েছে এরদোগানের ‘ইসলামপন্থী’ হিসেবে পরিচিত দল জাস্টিস অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টি (একে পার্টি)। ৪১ শতাংশ ভোট নিয়ে এখন জোট সরকার গঠনের জন্য অপেক্ষা করতে হচ্ছে দলটিকে। অন্যদিকে, দ্বিতীয় ও তৃতীয় অবস্থানে থাকা দলগুলোর সঙ্গে মতাদর্শিক ভিন্নতা থাকায় জোট সরকার গঠনের সম্ভাবনাও ক্ষীণ হিসেবে দেখছেন বিশ্লেষকরা। সংবাদসূত্র : বিবিসি, আল-জাজিরা, এএফপি অনলাইন
যা আছে ভোটের ফলে
গত রোববারের ওই নির্বাচনের বেসরকারি ফল অনুযায়ী, জাস্টিস অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টি (এ কে পার্টি) ৪১ শতাংশ ভোটে প্রথম স্থান অধিকার করেছে। তবে প্রথম স্থানে থাকলেও গত ১৩ বছরে প্রথমবারের মতো এককভাবে সরকার গঠনে প্রয়োজনীয় ২৭৬টি আসন অর্জনে ব্যর্থ হয়েছে দলটি। ক্ষমতাসীন এ কে পার্টির পর রিপাবলিকান পিপলস পার্টি (সিএইচপি) ২৫ শতাংশ এবং ন্যাশনালিস্ট মুভমেন্ট পার্টি (এমএইচপি) পেয়েছে ১৬ দশমিক ৫ শতাংশ ভোট। আর প্রথমবারের মতো নির্বাচনে অংশ নেয়া কুর্দিপন্থী পিপলস ডেমোক্রেটিক পার্টি (এইচডিপি) ১৩ দশমিক ১২ শতাংশ ভোট নিয়ে রয়েছে চতুর্থ স্থানে। অর্থাৎ, সামগ্রিক ফলে ৫৫০ আসনবিশিষ্ট পার্লামেন্টে এবার প্রতিনিধিত্ব করবেন এ কে পার্টির ২৫৮, সিএইচপির ১৩২, এমইচপির ৮১ এবং এইচডিপির ৭৯ জন সদস্য।
গত রোববার অনুষ্ঠিত নির্বাচনে মোট ভোট পড়েছে ৮৬ শতাংশ। আনুষ্ঠানিক ফল পেতে আরো ১০ দিনের বেশি অপেক্ষা করতে হবে বলে জানিয়েছেন দেশটির নির্বাচন কমিশনের চেয়ারম্যান সাদি গুভেন। শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত এ কে পার্টির পক্ষ থেকে নির্বাচনের ফল মেনে নিয়েছেন দলটির প্রধান ও তুরস্কের প্রধানমন্ত্রী আহমেদ দাউদউলু। এছাড়া তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোগান সব দলের প্রতি স্থিতিশীলতা বজায় রাখার আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি আরো জানিয়েছেন, জোট গঠনের জন্য আলোচনা শুরু করেছে এ কে পার্টি।
হতে পারে আগাম নির্বাচনও
নির্বাচনে আসনের ভিত্তিতে প্রথম ৪টি দলের ভিন্ন ভিন্ন আদর্শ এবং নীতিগত বিরোধের কারণে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে নতুন সরকার গঠনে অনিশ্চয়তা। ইসলামপন্থী এ কে পার্টি প্রথম স্থানে থাকলেও ওই দলকে বাদ দিয়ে বাকি তিনটি দলের জোট সরকার গঠনের সম্ভাবনা উড়িয়ে দিচ্ছেন না রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা। সেক্ষেত্রে নতুন সরকারের পুরো মেয়াদ দায়িত্বে থাকা নিয়েও সন্দেহ প্রকাশ করেছেন অনেকে। আবার তুরস্কের জাতীয় একটি টিভি অনুষ্ঠানে এ কে পার্টির সাবেক নেতারা বলেছেন, তারা আগাম নির্বাচনের আশঙ্কা করছেন। এ কে পার্টির সম্ভাব্য জোটসঙ্গী হিসেবে যাকে ভাবা হচ্ছিল, সেই এমএইচপির নেতা ডেভলেট বাহচেলি তার দলের জোট সরকারের অংশ হওয়ার সম্ভাবনা নাকচ করে দিয়েছেন? খুব তাড়াতাড়ি নতুন নির্বাচন অনুষ্ঠানের দাবি জানিয়েছেন তিনি।
কুর্দিদের ব্যাপক জয়োচ্ছ্বাস
নির্বাচনের ফল আসতে থাকার পরপরই তুরস্কের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের কুর্দি অধ্যুষিত দিয়ারবাকির শহরের রাজপথে নেমে আসে উৎসবমুখর জনতা। গাড়ির হর্ন দিয়ে, ভেঁপু বাজিয়ে, নেচে-গেয়ে আনন্দ প্রকাশ করে তারা। কুর্দিপন্থী দল এইচডিপির সমর্থকরা সস্নোগান দিতে দিতে বলেন, ‘আমরা এইচডিপি, আমরা পার্লামেন্টে যাচ্ছি।’ তুরস্কের রাজনীতিতে এইচডিপির এই উত্থানকে কুর্দিদের ঐক্যের প্রতীক এবং গণতন্ত্রের পথে এগিয়ে যাওয়ার একটি পদক্ষেপ হিসেবে বর্ণনা করেছেন দলটির সমর্থক ইয়ালমান। তার ভাষ্য, ‘এ কে পার্টির একনায়কসুলভ কর্তৃত্বের বিরুদ্ধে এটা একটা সতর্কতা।’
তুরস্কের মোট জনসংখ্যার ২০ শতাংশ কুর্দি। তারা দেশটির সবচেয়ে বড় সংখ্যালঘু। এবারকার নির্বাচনের মাধ্যমে পার্লামেন্টে কুর্দিদের সত্যিকারের প্রতিনিধিত্ব সৃষ্টি হতে চলেছে। এর আগে বিভিন্ন দলের হয়ে কুর্দিরা পার্লামেন্টে গেলেও এবারই প্রথম নিজেদের দল সৃষ্টি করে পার্লামেন্টে যাবে তারা। তবে শুধু কুর্দিরাই নয়, এবারকার নির্বাচনে এইচডিপিকে সমর্থন দিয়েছে বিভিন্ন বামপন্থী এবং প্রগতিশীল দলও। নির্বাচনে অংশ নেয়া যে কোনো দলের তুলনায় এইচডিপিতে নারী প্রার্থীর সংখ্যা বেশি। আবার এই নির্বাচনে একজন সমকামীকে প্রার্থিতা দেয়ার মতো সাহসও দেখিয়েছে তারা।
এরদোগানের স্বপ্নপূরণ হলো না
গত রোববারের ওই নির্বাচনে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জনের মধ্য দিয়ে তুরস্কের সংবিধান পরিবর্তন করে আমেরিকার মতো শক্তিশালী প্রেসিডেন্ট পদ্ধতির শাসন প্রবর্তন করতে চেয়েছিলেন এরদোগান। কিন্তু নির্বাচনের অপ্রত্যাশিত ফলে তার পরিকল্পনা বাস্তবায়ন এখন প্রায় অসম্ভব হয়ে দাঁড়িয়েছে। দেশটির সংবিধান অনুযায়ী, ৩৫০টি আসন পেলে গণভোট প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে এবং ৩৬৭টি আসনের বেশি পেলে একক সিদ্ধান্তের মাধ্যমেই প্রেসিডেন্ট পদ্ধতির শাসন প্রবর্তন করতে পারত দলটি।