অনলাইন ডেস্ক
০৬ মার্চ ২০১৭ ইং ০১:০৫ মিঃ
সবার কাছে রায়হান নামেই পরিচিত তিনি। এক হাত নেই। কাটা পড়েছে আরেক হাতের কনুই পর্যন্ত। দারিদ্র্যও থামাতে চেয়েছে বারবার। মনোবল আর সাহস যাঁর সঙ্গী, নাম তার বাহার উদ্দিন। মুখ ও হাতের কনুই দিয়ে লিখেই পাস করেছেন উচ্চমাধ্যমিক। থেমে থাকেননি। এখন তিনি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। ২০১৬-১৭ শিক্ষাবর্ষে ভর্তি হয়েছেন কলা ও মানববিদ্যা অনুষদের ইতিহাস বিভাগের স্নাতক প্রথম বর্ষে। বাড়ি কক্সবাজারের চকরিয়া উপজেলার লক্ষ্যারচর ইউনিয়নের ২ নম্বর ওয়ার্ডের জহিরপাড়ায়। বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়াশোনার জন্য এখন তিনি শহরবাসী। নগরের নতুন ব্রিজ এলাকায় আত্মীয়র বাড়িতে থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ে যাতায়াত করেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে আসা-যাওয়াও তাঁর জন্য কম ঝক্কি নয়। প্রথমে টেম্পোতে নতুন ব্রিজ থেকে দুই কিলোমিটার দূরত্বের বটতলী রেলস্টেশনে, এরপর বিশ্ববিদ্যালয়ের শাটল ট্রেন। এভাবেই ২৫ কিলোমিটার দূরের ক্যাম্পাসে আসা-যাওয়া তাঁর।
এত কষ্ট করে লেখাপড়া? রায়হানের মুখে হাসি। বললেন, ‘কই কষ্ট। পড়াশোনা না করলে ক্যারিয়ার গড়ব কীভাবে।’ কথাগুলো বলার সময় তাঁর কণ্ঠ দৃঢ়। রায়হানের সঙ্গে কথা হয় গত মঙ্গলবার দুপুরে প্রথম আলোর চট্টগ্রাম কার্যালয়ে। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দেড়টার ট্রেনে ফিরেছেন।
রায়হান বলেন, ‘জন্মের আগে হারিয়েছি বাবাকে। অভাব ছিল নিত্যসঙ্গী। হাত হারানোর পরও আমি বসে থাকিনি। কিছু না কিছু নিয়ে ব্যস্ত থেকেছি।’
পাখি দেখতে জীবন বিপন্ন
২০০৪ সালের ৩০ অক্টোবর। বিকেল সাড়ে পাঁচটা। সেদিন ছিল শবে বরাত। রায়হান তখন পঞ্চম শ্রেণির ছাত্র। দুরন্তপনায় মাতিয়ে রাখতেন পাড়া। জহিরপাড়ায় পল্লী বিদ্যুতের সরবরাহ লাইন টানা হয়েছে সবে। গ্রাহকদের বিদ্যুৎ–সংযোগ দেওয়া হয়নি। বাড়ির পাশে বৈদ্যুতিক খুঁটিতে বসানো ট্রান্সফরমারে একটি ছোট পাখি ঢুকে পড়ে। রায়হান কিছুক্ষণ অপেক্ষার পরও দেখেন পাখি বেরোচ্ছে না। এরপর নিজেই পাখির অবস্থা দেখার জন্য খুঁটি বেয়ে ওপরে উঠতে থাকেন। ট্রান্সফরমারের কাছে এসে তারে হাত দিতেই বিকট শব্দে ছিটকে পড়েন নিচে। ঝলসে যায় তাঁর দুই হাত, বুকের কিছু অংশ ও পায়ের তালু। আত্মীয়স্বজন তাঁকে উদ্ধার করে ভর্তি করেন চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালে। পাঁচ দিনের মধ্যে কেটে ফেলা হয় রায়হানের এক হাত ও আরেক হাতের কনুই পর্যন্ত। ১৬ দিন পর জ্ঞান ফেরে তাঁর। দেখেন হাত নেই। পুরো শরীর ব্যান্ডেজে মোড়ানো। চিকিৎসকেরা পরামর্শ দেন, ভারতের মাদ্রাজ নিয়ে চিকিৎসা করাতে। কিন্তু অর্থের অভাবে সম্ভব হয়নি। আত্মীয়স্বজন চমেক হাসপাতালে চিকিৎসা করানোর সিদ্ধান্ত নেন। যত দিন বাঁচে! বুকের ধনকে আগলে রাখেন মা খালেদা বেগম। ধীরে ধীরে সুস্থ হন রায়হান। বাড়ি ফেরেন ছয় মাস পর।
ঘুরে দাঁড়ােনোর গল্পটা জেনে নেই আসুন..
হাসপাতাল থেকে ফিরে কিছুদিন ঘরে কাটিয়েছেন রায়হান। একদিন খালাতো বোন বললেন, ‘তুই তো পায়ে কিংবা মুখে লিখতে পারিস। চেষ্টা করে দেখ।’ রায়হান কাজে লেগে যান। মুখে কলম নিয়ে লেখার চেষ্টা করেন। প্রথমে কিছুই হয় না। কয়েক দিন যেতেই অক্ষর লেখাটা আয়ত্ত হয়ে যায়। রায়হানের ভাষায়, ‘সেই দিনটি আমার ভীষণ আনন্দের। আমি আবার লিখতে পারছি।’ লেখা শিখতে শুরু করার দুই মাস পর ২০০৬ সালের মাঝামাঝি সময়ে তাঁদের গ্রামের আল রায়েদ কমপ্লেক্স নামের একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভর্তি হন রায়হান। শিক্ষক ও আত্মীয়স্বজনের পরামর্শে আবার তৃতীয় শ্রেণি থেকে পড়া শুরু করেন। এরপর ২০০৮ সালে ভর্তি হন চকরিয়া সরকারি উচ্চবিদ্যালয়ে।
তথ্য সুত্রঃ প্রথম আলো (০৪ মার্চ ২০১৭ ইংজ