মিয়ানমার থেকে বাস্তুচ্যুত হয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় গ্রহণকারী রোহিঙ্গাদের দেশে ফিরিয়ে নেয়ার লক্ষে সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য ইসলামিক ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক গ্রুপ (আইএসডিবিজি) এর প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশ জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুত বিপুল রোহিঙ্গা জনস্রোতের নজিরবিহীন এক মানবিক সংকটে অত্যন্ত সক্রিয়ভাবে সাড়া দিয়ে সীমান্ত উন্মুক্ত রেখে এবং তাদের প্রবেশ করতে দিয়েছে। কিন্তু এখন আমরা তাদের নিজ দেশে ফেরত পাঠাতে চাই। মিয়ানমারের রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী যখন জাতিগত নির্মূলের মুখোমুখি তখন আইডিবি নিশ্চুপ থাকতে পারে না।’
আজ রবিবার সকালে হোটেল র্যাডিসনে ইসসলামী ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক গ্রুপের (আইএসডিবিজি) ঢাকাস্থ ‘রিজিওনাল হাব’ উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির ভাষণে প্রধানমন্ত্রী এসব কথা বলেন।
রোহিঙ্গরা স্থানীয় জনগোষ্ঠী এবং প্রতিবেশের ওপর ব্যাপক নেতিবাচক প্রভাব সৃষ্টি করছে উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, ‘কাজেই জোরপূর্বক বিতাড়িত রোহিঙ্গাদের নিরাপদে নিজ দেশে ফিরে যাওয়া নিশ্চিত করার জন্য আইডিবিকে আমি দৃঢ়ভাবে তাদের পাশে দাঁড়ানোর অনুরোধ জানাচ্ছি।’
পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন সেক্টরে বিনিয়োগের চাহিদা, বর্তমান অবস্থা ও ঘাটতি পর্যালোচনা করার জন্য কান্ট্রি ইনভেস্টমেন্ট প্লান বাস্তবায়নের ক্ষেত্রেও আইএসডিবিজি’র সহযোগিতা কামনা করেন প্রধানমন্ত্রী।
তিনি বলেন, ‘বিনিয়োগ পরিকল্পনা মতে সম্পূর্ণ মেয়াদে মোট ১১ দশমিক ৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের প্রয়োজন। দেশীয় ও আন্তর্জাতিক উৎস হতে এ পর্যন্ত ৪ দশমিক ৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলার বিনিয়োগ করা হয়েছে। অর্থাৎ আরও ৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের ঘাটতি রয়েছে। এ ঘাটতি পূরণে আপনাদের সহযোগিতা প্রয়োজন।’
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমরা ২০২১ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে মধ্যম আয়ের দেশ এবং ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত-সমৃদ্ধ দেশে পরিণত করতে সক্ষম হব ইনশাআল্লাহ। আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, এ উন্নয়ন অগ্রযাত্রায় আপনাদের সমর্থন ও সহযোগিতা অব্যাহত রাখবেন।’
‘সকলে মিলে আমরা নতুন প্রজন্মের জন্য উজ্জ্বল-সমৃদ্ধ ভবিষৎ গড়ে তুলব’-এ কথা উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে আমরা সফল হয়েছি। এখন জাতীয় পরিকল্পনা এবং কর্মকৌশলের মাধ্যমে ২০৩০ সালের মধ্যেই টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) বাস্তবায়নের লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছি।
ঢাকায় আইএসডিবিজি এর রিজিওনাল হাব স্থাপনকে স্বাগত জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, এটি ইসলামী উন্নয়ন ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা কার্যক্রম সদর-দপ্তর থেকে প্রশাসনিক বিকেন্দ্রীকরণের অংশ। এর ফলে প্রকল্প ব্যবস্থাপনা, বাস্তবায়ন, পর্যবেক্ষণ ও অন্যান্য আর্থিক ও প্রশাসনিক কার্যক্রমকে আরও দক্ষ, উন্নত ও গতিশীল করবে।
এ উদ্যোগ সদস্য রাষ্ট্রের উন্নয়ন অগ্রাধিকার, প্রয়োজন ও চ্যালেঞ্জসমূহ আরও ঘনিষ্ঠভাবে বুঝতে আইএসডিবিকে সহায়তা করবে, বলেন তিনি।
শেখ হাসিনা বলেন, আইএসডিবি বাংলাদেশের অন্যতম বিশ্বস্ত উন্নয়ন-সহযোগী। আমাদের দেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে বিগত চার দশকে আইএসডিবির ভূমিকা উল্লেখযোগ্য।
তিনি বলেন, আইএসডিবি এ পর্যন্ত বাংলাদেশকে ২২ বিলিয়ন মার্কিন ডলার উন্নয়ন সহযোগিতা প্রদান করেছে। ৫৭টি সদস্য রাষ্ট্রের মধ্যে বাংলাদেশ সর্ববৃহৎ অর্থনৈতিক সহযোগিতা গ্রহণকারী দেশ।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ঢাকায় নতুন অফিস স্থাপন বাংলাদেশের সঙ্গে আইএসডিবির সম্পর্ক সুসংহত এবং অংশীদারিত্ব সুদৃঢ় করার আরও একটি ধাপ বলে আমি মনে করি।
বাংলাদেশের জনগণের টেকসই আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে তাঁর সরকার কাজ করে যাচ্ছে উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, কিন্তু এ অভিযাত্রা কখনোই মসৃন ছিল না। আমাদের দক্ষ নেতৃত্ব ও জনগণের বলিষ্ঠ প্রচেষ্টায় বাংলাদেশ ‘তলাবিহীন ঝুঁড়ি’ থেকে আজ উন্নয়নশীল দেশের মর্যাদা পেয়েছে। জাতিসংঘের উন্নয়ন-নীতি বিষয়ক কমিটি (সিডিপি)-এ স্বীকৃতি দিয়েছে। স্বল্প সময়ের মধ্যেই উন্নত দেশ হবার পথে এ যাত্রা অব্যাহত রেখেছি। ২০৪১ সালের মধ্যে সুখী-সমৃদ্ধ-উন্নত রাষ্ট্র হওয়া আমাদের পরবর্তী লক্ষ্য।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে বাংলাদেশ বিশ্বব্যাপী ‘উন্নয়নের বিস্ময়’, যা অন্যদের জন্য অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত। জিডিপির আকারে বাংলাদেশ বর্তমানে পৃথিবীর ৪৩তম বড় এবং ক্রয়ক্ষমতা অনুযায়ী ৩২তম বৃহৎ অর্থনীতি।
তিনি বলেন, দারিদ্র্যসীমা বর্তমানে ২২ শতাংশে নেমে এসেছে। কর্মসংস্থান সৃষ্টির জন্য আমরা ১০০টি বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল, হাইটেক পার্ক, সফটওয়্যার প্রযুক্তি পার্ক স্থাপন করার পাশাপাশি বেসরকারি ও বৈদেশিক বিনিয়োগও সহজতর করছি। এ ছাড়াও অবকাঠামোগত চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় আমরা বেশ কিছু বৃহৎ প্রকল্প গ্রহণ করেছি। আমরা নিজস্ব অর্থায়নে অন্যতম বৃহৎ প্রকল্প পদ্মা সেতু তৈরি করছি।
শেখ হাসিনা বলেন, দেশের সামষ্ঠিক অর্থনীতি ব্যবস্থাপনায় আমরা উন্নয়ন ধরে রাখতে পেরেছি। ২০১৭-২০১৮ অর্থবছরে জিডিপি ৭ দশমিক ৭৮ শতাংশে উন্নীত হয়েছে। মাথাপিছু আয় ১৭৫২ মার্কিন ডলারে উন্নীত হয়েছে। গত দশ বছরে মুদ্রাস্ফীতি ১২ দশমিক ৩ শতাংশ হতে ৫ দশমিক ৮ শতাংশে নেমে এসেছে। সরকারের রাজস্ব-জিডিপির অনুপাত ১০ দশমিক ৩ শতাংশ। চলতি অর্থবছরে বাজেটের আকার ৪ লাখ ৬৪ হাজার ৫৭৩ কোটি টাকা। রপ্তানি আয় ৩৪ দশমিক ৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। বাৎসরিক আমদানি ৪৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে পৌঁছেছে। বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ৩২ দশমিক ৯ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। প্রবাসীদের প্রেরিত অর্থ প্রবাহ প্রায় ১৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার।
প্রতিবেশী দেশসমূহের তুলনায় মানবসম্পদ উন্নয়নে বাংলাদেশ এগিয়ে রয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, আমরা সাধারণ শিক্ষা, পেশাগত শিক্ষা, কারিগরি শিক্ষা ও তথ্য-প্রযুক্তি শিক্ষার ওপর গুরুত্ব দিচ্ছি।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমরা সাড়ে ১৮ হাজার কমিউনিটি ক্লিনিকে ১৩ হাজার ৮৪২ জন স্বাস্থ্য-সেবা প্রদানকারী নিয়োগের মাধ্যমে গ্রামীণ ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জন্য স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করে যাচ্ছি।
তিনি বলেন, প্রতি হাজারে শিশুমৃত্যু হার ২৮ ও মাতৃমৃত্যুর হার ১ দশমিক ৭৬ -এ নামিয়ে আনা হয়েছে। বর্তমানে এক বছরের কম শিশুদের মধ্যে টিকা প্রদানের হার ৮২ দশমিক ৩ শতাংশ এবং ভিটামিন-এ ক্যাপসুল খাওয়ার হার ৯২ শতাংশ। মানুষের গড় আয়ু বর্তমানে ৭২ বছরের বেশি। ২৪ ঘণ্টা জনগণকে বিনামূল্যে চিকিৎসা পরামর্শ দেওয়ার জন্য “স্বাস্থ্য-জানালা” চালু করা হয়েছে।
তাঁর সরকার বিদ্যুৎ ও জ্বালানি সেক্টরকে অগ্রাধিকার প্রদান করেছে উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, ২০০৯ সালে দেশে বিদ্যুৎ উৎপাদনের সক্ষমতা ছিল মাত্র ৪ হাজার ৯৪২ মেগাওয়াট। যা বর্তমানে চারগুণ বৃদ্ধি পেয়ে প্রায় ২০ হাজার মেগাওয়াটে উন্নীত হয়েছে।
তিনি বলেন, বর্তমানে দেশে পাওয়ার প্ল্যান্টের সংখ্যা ১১৮টি। বিদ্যুতের সঞ্চালন ও বিতরণ ব্যবস্থাও উন্নত করা হয়েছে। বর্তমানে শতকরা ৯০ জন বিদ্যুৎ সুবিধা ভোগ করছে। আমাদের লক্ষ্য ২০২১ সালের মধ্যে ২৪ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের মাধ্যমে দেশের সকল মানুষের কাছে সাশ্রয়ী মূল্যে বিদ্যুৎ সরবরাহ করা। এ ছাড়াও জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে নতুন তেল ও গ্যাসক্ষেত্র অনুসন্ধানে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। আমরা তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) আমদানি শুরু করেছি।
বাংলাদেশ ইতোমধ্যে প্রযুক্তি-নির্ভর ডিজিটাল বাংলাদেশে পরিণত হয়েছে উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, দেশের প্রান্তিক অঞ্চলকে সংযুক্ত করার জন্য বিস্তৃত তথ্য-প্রযুক্তির অবকাঠামো তৈরি করা হয়েছে। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কৃষি, জন্ম নিবন্ধন এবং সামাজিক-ভাতাসহ ২০০ প্রকার সরকারি সেবা এখন জনসাধারণের হাতের নাগালে। ১৮ হাজার সরকারি অফিস একটি সমন্বিত নেটওয়ার্কের সঙ্গে সংযুক্ত হয়েছে।
তিনি বলেন, দেশে বর্তমানে ৯১ শতাংশ টেলি ঘনত্ব এবং ৫০ দশমিক ১ শতাংশ ইন্টারনেট ঘনত্ব রয়েছে। দেশে বর্তমানে ১৫ কোটি ৩ লাখ মানুষ মোবাইল ফোন এবং ৮ থেকে ৬ কোটি মানুষ ইন্টারনেট ব্যবহার করে।
সরকার প্রধান বলেন, সরকারি অফিসে ই-ফাইলিং, ইলেকট্রনিক কেনাকাটা (ই-জিপি), ই-কমার্স, স্থানীয় পর্যায়ে ডিজিটাল সেন্টার, মোবাইলের মাধ্যমে স্বাস্থ্যসেবা, ডিজিটাল পরীক্ষাগার ও মাল্টিমিডিয়া শ্রেণিকক্ষ ব্যবহার করা হচ্ছে।
দেশের প্রথম স্যাটেলাইট সফলভাবে উৎক্ষেপণের প্রসঙ্গ উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, গত ১১ মে, ২০১৮ তারিখে মহাশূন্যে দেশের প্রথম কৃত্রিম উপগ্রহ ‘বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১’ উৎক্ষেপণের মাধ্যমে বাংলাদেশ ৫৭তম দেশ হিসেবে স্যাটেলাইট ক্লাবে যুক্ত হওয়ার গৌরব অর্জন করেছে।
সমাজের সকল স্তরে নারী-পুরুষের সমান অধিকার নিশ্চিত করার লক্ষ্যে তাঁর সরকার ‘জাতীয় নারী উন্নয়ন নীতি-২০১১’ ও জেন্ডার বাজেট প্রণয়ন করেছে উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘বৈশ্বিক লিঙ্গ-বৈষম্য প্রতিবেদন ২০১৭’ অনুযায়ী ১৪৪টি রাষ্ট্রের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ৪৭তম। এক্ষেত্রে ভারত, শ্রীলংকা, মালদ্বীপ, নেপাল, ভুটান এবং পাকিস্তানের চেয়ে বাংলাদেশ এগিয়ে রয়েছে।
তিনি বলেন, আমরা ৩ দশমিক ৫ মিলিয়ন নারী পোশাক শ্রমিকদের নিরাপদ ও সুরক্ষিত কর্মক্ষেত্র তৈরির জন্য বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করেছি।
দেশের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার সাফল্য তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় বাংলাদেশ আন্তর্জাতিকভাবে প্রশংসিত হয়েছে। কিন্তু জলবায়ু পরিবর্তনজনিত যে কোন ইস্যুতে বাংলাদেশ অন্যতম ক্ষতিগ্রস্ত রাষ্ট্র।
জলবায়ুর অভিঘাত মোকাবেলায় তাঁর সরকারের উদ্যোগ তুলে ধরে সরকার প্রধান বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব প্রশমন এবং অভিযোজন করার জন্য ‘বাংলাদেশ জলবায়ু পরিবর্তন কর্মকৌশল ও কর্মপরিকল্পনা’ এর আওতায় বেশ কিছু কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছে।
তিনি আরো বলেন, বাংলাদেশ নিজস্ব অর্থায়নে বাংলাদেশ জলবায়ু পরিবর্তন ট্রাস্ট ফান্ড গঠন করেছে।