মানবতাবিরোধী অপরাধে অভিযুক্ত জামায়াতের সাবেক আমীর অধ্যাপক গোলাম আযমকে ২০১৩ সালের ১৫ই জুলাই আজীবন কারাবাসের দণ্ডাদেশ দেয় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১। তার বিরুদ্ধে প্রসিকিউশনের দাখিলকৃত ৫টি অভিযোগের সব ক’টি প্রমাণিত হওয়ায় ৯০ বছর বয়সী গোলাম আযমকে এ সাজা দেয়া হয়। তবে এর আগেই ২০১২ সালের ১২ই জানুয়ারি বার্ধক্যের কারণে শারীরিকভাবে অসুস্থ গোলাম আযমকে তার আইনজীবীর আবেদনক্রমে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে রাজধানীর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রিজন সেলে ভর্তি করা হয়। সেই থেকে তিনি এখনও প্রিজন সেলেই আছেন। গতকাল শারীরিক অবস্থার অবনতি হওয়ায় তাকে হাসপাতালের করোনারি কেয়ার ইউনিটে (সিসিইউ) ভর্তি করা হয়। বিএসএমএমইউ হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, বয়স তাকে কিছুটা কাবু করেছে। ডায়বেটিক ও উচ্চরক্তচাপজনিত সমস্যা মাঝেমধ্যে কিছুটা দুর্বল করে ফেলে তাকে। এ সমস্যার কারণে গতকাল হঠাৎ করে তাকে সিসিইউতে স্থানান্তর করা হয়।
প্রিজন সেলের কয়েকজন কারারক্ষী জানান, প্রতিদিন নিয়ম করে সেলের বারান্দায় ও কক্ষের ভেতরে তিনি হাঁটাহাঁটি করে শরীর ঠিক রাখার চেষ্টা করেন। কানে একটু কম শুনলেও বোধশক্তি তার যথেষ্টই রয়েছে এখনও। সেলে বেশির ভাগ সময় কাটান নামাজ, ইবাদত-বন্দেগি ও দেশী-বিদেশী নানা লেখকের বই পড়ে। বিএসএমএমইউ হাসপাতাল সূত্র জানিয়েছে, এখনও নিয়ম করে তিনি পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়েন। কখনও রোজা রাখেন। হাসপাতালের নিয়ামানুযায়ী তিনি স্বাভাবিক সব খাবার খান। তবে খাবারের বিষয়ে তার রুচিবোধ এখনও প্রবল। এ জন্য মাঝেমধ্যে বাসা থেকে তৈরি করে আনা খাবার তাকে সরবরাহ করা হয়। হাসপতাল কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, সকালে তাকে রুটি, ডিম, কলা ও চা দেয়া হয়। বেলা এগারটায় দেয়া হয় হালকা খাবার যেমন বিস্কুট ও দুধ। দুপুরের মেন্যুতে থাকে ভাত, সবজি, রুই মাছ ও ডাল। বিকালে দেয়া হয় দুধ, বিস্কুট অথবা চা। গোলাম আযম ভর্তা ভাজি খেতে পছন্দ করেন। এ জন্য কারাগার ও হাসপাতালের বিশেষ অনুমতিক্রমে মাঝেমধ্যে তাকে দেয়া হয় বাসায় তৈরি বিভিন্ন ভর্তা, মাছ ভর্তা ও ভাজি। তার প্রতিদিনের খাবারের তালিকায় রয়েছে বিশেষভাবে তৈরী আম, জলপাই ও বড়ইয়ের আচার। এ জন্য তা বাসা থেকে তৈরি করে নিয়ে আসা হয়। প্রতি সপ্তাহে তাকে এ বিশেষ খাবারটি হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের অনুমতিক্রমে সরবরাহ করে পরিবার।
২০০১ সাল থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের প্রভাবশালী স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী ছিলেন লুৎফুজ্জামান বাবর। যত দিন মন্ত্রীর পদে ছিলেন তত দিন আলোচনা-সমালোচনা ছিল তাকে নিয়ে। কিন্তু সময় তাকে কাবু করে ফেলেছে। এক প্রকার বিস্মৃতির অতলে হারিয়ে যাচ্ছেন তিনি। এমনকি নিজ দল বিএনপিতেও তার নাম উচ্চারিত হয় কালেভদ্রে। ইতিমধ্যে তিনি অস্ত্র, চোরাচালানসহ নানা মামলায় ফাঁসিসহ বিভিন্ন মেয়াদের কারাদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি। চলতি বছরের ৩০শে জানুয়ারি ঘোষিত চট্টগ্রামে ১০ ট্রাক অস্ত্র মামলার রায়ে ফাঁসির আদেশ হয়েছে তার। এ ছাড়া আরও অনেক মামলার খড়গ ঝুলছে তার মাথায়। বিভিন্ন মেয়াদে ছিলেন গাজীপুরের কাশিমপুর কেন্দ্রীয় কারাগার ও ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে। বর্তমানে তার ঠাঁই হয়েছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রিজন সেলে। হাসপাতাল সূত্রে জানা গেছে, সব মিলিয়ে ভাল নেই জোট সরকারের সাবেক এ প্রভাবশালী মন্ত্রী। শরীরে বাসা বেঁধেছে নানা অসুখ। গুরুতর শারীরিক অসুস্থতার কারণে তাকে এখানে ভর্তি করা হয়েছে চলতি বছরের ২৬শে জুন। প্রচণ্ড শ্বাসকষ্ট, ঘাড়ে ব্যথা, উচ্চরক্তচাপসহ শারীরিক নানা জটিলতায় ভুগছেন সাবেক এ মন্ত্রী। সূত্র জানিয়েছে, শারীরিক অসুস্থতা কাবু করে ফেলেছে তাকে। এ জন্য প্রিজন সেলের বাইরে খুব একটা বের হন না তিনি। বেশির ভাগ সময় কাটে নামাজ ও ইবাদত-বন্দেগি করে, বই পড়ে ও ঘুমিয়ে। ফাঁসির আসামি বিধায় এক মাস পরপর প্রিয়জনদের সঙ্গে দেখা করার সুযোগ পান বাবর। এ ছাড়া প্রতিনিয়ত বিভিন্ন মামলায় তাকে দেশের বিভিন্ন আদালতে হাজিরা দিতে হয়। খাবারের বিষয়ে তার তেমন পছন্দ নেই। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের সরবারহকৃত খাবারই তাকে খেতে হয় রোজ। সকালে তাকে দেয়া হয় একটি করে পাউরুটি, কলা, সিদ্ধ ডিম ও চা। বেলা এগারোটায় তাকে দেয়া হয় ২ শ’ মিলিলিটার সমপরিমাণ দুধ ও বিস্কুট। দুপুর দুটায় দেয়া হয় ভাত, সবজি, রুই মাছ ও ডাল। বিকালে তাকে দেয়া হয় চা ও বিস্কুট। এ ছাড়া বাবরের রাতের খাবারের মেন্যুতে থাকে মুরগির মাংস, ভাত, সবজি ও ডাল। প্রিজন সেলের চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, তার শারীরিক অবস্থা ভাল নয়। শ্বাসকষ্টজনিত সমস্যা তাকে ভোগাচ্ছে বেশি। এ ছাড়া ঘাড়ে ব্যথাসহ নানা শারীরিক অসুখে ভুগছেন তিনি।
ঢাকার লালবাগ এলাকার বিএনপির সাবেক সংসদ সদস্য ও সাবেক ছাত্রদল সভাপতি নাসিরউদ্দিন আহমেদ পিন্টুর ঠাঁই হয়েছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল হাসপাতালের প্রিজন সেলে। ২০০৯ সালের ২৫ ও ২৬শে ফেব্রুয়ারি রাজধানীর পিলখানার বিডিআর বিদ্রোহে সংঘটিত হত্যা মামলার রায়ে তিনি অভিযুক্ত হলে ৫ই নভেম্বর ঘোষিত রায়ে তাকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডাদেশ দেয় আদালত। সেই থেকে তিনি ছিলেন ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে। এরপর শারীরিক সমস্যার কারণে কারা হাসপাতালের সুপারিশক্রমে চলতি বছরের ২রা জুন তাকে ভর্তি করা হয় বিএসএমএমইউ’র প্রিজন সেলে। প্রিজন সেলের চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, বিএনপি নেতা নাসিরউদ্দিন পিন্টুর নাকের হাড় বাঁকা। এ জন্য মাঝেমধ্যেই সর্দিজনিত গুরুতর সমস্যায় ভোগেন তিনি। এ ছাড়া উচ্চ রক্তচাপ ও ডায়াবেটিসজনিত সমস্যায় ভুগছেন এক সময়ের প্রভাবশালী এ সংসদ সদস্য। তবে প্রিজন সেলের কয়েকজন নিরাপত্তাকর্মী জানান, খাবারের তালিকা নিয়ে মাঝেমধ্যে উষ্মা প্রকাশ করতে দেখা যায় তাকে। এ জন্য নিয়মানুযায়ী কখনও কখনও বাসা থেকে আনা খাবার সরবরাহ করে তার পরিবার। যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত আসামি হিসেবে সাত দিন পরপর পরিবার পরিজনের সঙ্গে দেখা-সাক্ষাতের সুযোগ পান নাসিরউদ্দিন আহমেদ পিন্টু। প্রিজন সেলে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের সরবাহ করা তার খাবারের তালিকায় সকালে থাকে পাউরুটি, কলা, ডিম ও চা। বেলা এগারোটায় দেয়া হয় দুধ ও বিস্কুট। এ ছাড়া দুপুরে তাকে দেয়া হয় সবজি, ভাত, রুই মাছ ও ডাল। রাতের বেলায় দেয়া হয় মুরগির মাংস, ভাত, সবজি ও ডাল। বিএসএমএমইউ হাসপাতাল সূত্র জানিয়েছে, প্রতিদিন প্রিজন সেলে অবস্থানরত গোলাম আযম, বাবর ও পিন্টুর স্বাস্থ্য পরীক্ষা করেন নির্ধারিত চিকিৎসকরা। সে অনুযায়ী তাদের চিকিৎসা ও ওষুধ সরবরাহ করা হয়।
হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) মো. আ. মজিদ ভূঁইয়া মানবজমিনকে বলেন, প্রিজন সেলে রাজনৈতিক নেতা যারা আছেন তাদের কারাবিধি ও হাসপাতালের নিয়মানুযায়ী খাবার ও পানীয় সরবরাহ করা হয়। প্রতিদিন নিয়ম করে বেশ ক’জন চিকিৎসক তাদের শারীরিকভাবে পরীক্ষা-নীরিক্ষা করে রিপোর্ট করেন। সে অনুপাতে কারাবন্দিদের জন্য ওষুধ সরববরাহ করা হয়। চিকিৎসায় যদি রোগী সুস্থ হয় তবেই আমরা রোগীকে ছাড়পত্র দিই। তিনি বলেন, শুধু রাজনৈতিক নেতা বলেই নন প্রিজন সেলে যারা যত দিন থাকে তত দিন আমরা সেই রোগীকে গুরুত্ব সহকারে বিবেচনা করে চিকিৎসা ও আনুষঙ্গিক অন্যান্য বিষয় দেখভাল করি। এ বিষয়ে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের জ্যেষ্ঠ জেল সুপার মো. ফরমান আলী বলেন, কারাবিধি অনুযায়ী কারা হাসপতালের চিকিৎসকের সুপারিশক্রমে গোলাম আযম, বাবর ও পিন্টুকে বিএসএমএমইউ’র প্রিজন সেলে ভর্তি করা হয়েছে। নিয়মানুযায়ী হাসপাতালের চিকিৎকরা যত দিন প্রয়োজন মনে করবেন তত দিনই তারা প্রিজন সেলে চিকিৎসাধীন থাকবেন। তবে তারা সবাই কারাবিধি অনুযায়ী তৃতীয় শ্রেণীর বন্দি। তিনি বলেন, প্রিজন সেলে আমরা শুধু সাজাপ্রাপ্ত আসামির নিরাপত্তার বিষয়টি দেখে থাকি। তাদের খাবার ও চিকিৎসাজনিত বিষয়টি দেখে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ।
গোলাম আযম সিসিইউতে: জামায়াতে ইসলামীর সাবেক আমীর অধ্যাপক গোলাম আযমের শারীরিক অবস্থার অবনতি হয়েছে। গুরুতর অবস্থায় তাকে রাজধানীর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালের করোনারি কেয়ার ইউনিটে (সিসিইউ) ভর্তি করা হয়েছে। মানবতাবিরোধী অপরাধে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডপ্রাপ্ত অধ্যাপক গোলাম আযম দীর্ঘ দিন এই হাসপাতালের প্রিজন সেলে অবস্থান করেন। গতকাল সকাল সাড়ে আটটায় হঠাৎ তার ব্লাড প্রেসার বেড়ে গেলে সিসিইউতে নেয়া হয়। তার অবস্থা এখনও ঝুঁকিমুক্ত নয় বলে জানিয়েছেন দায়িত্বরত চিকিৎসক। গোলাম আযমের অসুস্থতার কথা শুনে হাসপাতালে ছুটে যান তার পুত্র সাবেক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আবদুল্লাহেল আমান আযমীসহ পরিবারের সদস্যরা। তারা গোলাম আযমের শারীরিক অবস্থার সর্বশেষ খোঁজ নেন। এদিকে ঢাকা মহানগর জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারী মুহাম্মদ সেলিম উদ্দিন অধ্যাপক গোলাম আযমের অসুস্থতায় গভীর উদ্বিগ প্রকাশ করেন। তিনি অধ্যাপক গোলাম আযমের দ্রুত আরোগ্যের জন্য দেশবাসী দোয়া চান। রাজধানীর মগবাজারে দলের রমনা জোনের উদ্যোগে দোয়া অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। জামায়াতের মজলিসে শুরা সদস্য ড.মুহাম্মদ রেজাউল করিম, তেজগাঁও থানা আমীর সালাউদ্দিন, শেরে-ই-বাংলানগর থানা আমীর আ.জ.ম কামাল উদ্দিন প্রমুখ দোয়া অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন।