ভারত এড়ালেও সুন্দর–বনের মধ্য দিয়েই নৌবাণিজ্যপথ চালু রেখেছে বাংলাদেশ। একসময় ভারতের অংশের সুন্দরবনের মধ্য দিয়ে এই নৌপথ চালু ছিল। কিন্তু সুন্দরবনের জীববৈচিত্র্য রক্ষায় নৌপথটি ঘুরিয়ে নিয়েছে ভারত। অথচ বাংলাদেশ লোকালয় এড়িয়ে সুন্দরবনের ভেতর দিয়েই নৌপথটি চালু রেখেছে।
২০১১ সালে ভারতের অংশে থাকা সুন্দরবনের হেমনগর অঞ্চলটি অভয়ারণ্য ঘোষণা দিয়ে হেমনগর-বাঘেরখাঁচা-নামখানা পথটি বন্ধ করে দেওয়া হয়। এর পরিবর্তে হেমনগর-কুমিরমারী-ঝড়খালী-নামখানা পথটি চালু করে ভারত। এ জন্য প্রায় ২০ কিলোমিটার বেশি ঘুরতে হয়। এতে সুন্দরবনের গহিন অংশটি এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব হয়।
আর এর উল্টো কাণ্ড ঘটেছে বাংলাদেশে। মংলা-ঘাসিয়াখালী খালের (এমজি ক্যানেল) পথটি বন্ধ করে শরণখোলা ও সুন্দরবনের ভেতর দিয়ে প্রায় ৭৫ কিলোমিটার ঘুরে নতুন পথ চালু করেছে বাংলাদেশ। সুন্দরবনের মধ্যে পড়েছে প্রায় ৬০ কিলোমিটার। অথচ সুন্দরবন পুরোপুরি এড়িয়ে ২০০৫ সাল পর্যন্ত এমজি খালটি ব্যবহার করতেন পণ্যবাহী জাহাজমালিকেরা। কিন্তু পলি পড়ে গভীরতা কমে যাওয়ায় এ পথটি জাহাজ চলাচলের অনুপযোগী হতে থাকে। ২০১১ সালে এ পথটি চূড়ান্তভাবে বন্ধ করে দেওয়া হয়।
উল্লেখ্য, এরই মধ্যে সুন্দরবন এলাকার শ্যালা নদীতে তেলবাহী জাহাজ ডুবে যাওয়ায় সেখানকার জীববৈচিত্র্য হুমকির সম্মুখীন হয়ে পড়েছে। শ্যালা নদী দিয়েও পণ্যবাহী জাহাজ চলাচল করে।
বাংলাদেশের এমন কাণ্ডকে ‘লজ্জাজনক সিদ্ধান্ত’ বলে মনে করেন বিশিষ্ট পানি বিশেষজ্ঞ ও ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক আইনুন নিশাত। তিনি বলেন, সংবিধানের ১৮(ক) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, রাষ্ট্র দায়িত্ব নিয়েছে জলাশয়, বন ও জীববৈচিত্র্য রক্ষার। সুন্দরবন একাধারে জলাশয়, বন ও জীববৈচিত্র্যে পূর্ণ। কিন্তু এ খালটি বন্ধ করে সুন্দরবনের মধ্য দিয়ে এ বাণিজ্যপথ নিয়ে যাওয়ার বিষয়টি সংবিধানসম্মত নয়।
অধ্যাপক আইনুন নিশাত আরও বলেন, দুই দেশের মধ্যে নৌবাণিজ্যপথটি সুন্দরবন থেকে বের করে আনা উচিত। তা না হলে জীববৈচিত্র্যের আরও ক্ষতি হবে। এখনই এর বিকল্প হিসেবে উপকূল ঘেঁষে পথ তৈরি করা যেতে পারে। সে ক্ষেত্রে বরগুনা জেলার আমতলী থেকে পায়রা নদী দিয়ে বঙ্গোপসাগরের উপকূল ঘেঁষে গেলেই সুন্দরবন এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব। তিনি মনে করেন, পরিবেশ নিয়ে সোচ্চার হওয়ায় ভারতও এ ব্যাপারে আপত্তি করবে না।
বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে সুন্দরবন এবং বেঙ্গল টাইগার রক্ষায় আলাদা দুটি প্রটোকল রয়েছে। ওই দুই প্রটোকল বাস্তবায়নে দুই দেশ সুন্দরবন রক্ষায় একসঙ্গে কাজ করবে বলে অঙ্গীকার করে। কিন্তু এখন পর্যন্ত ওই চুক্তি দুটি বাস্তবায়নে কোনো অগ্রগতিও হয়নি। বাঘ ও বন রক্ষায় কোনো যৌথ উদ্যোগও শুরু হয়নি।
বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআইডব্লিউটিএ) পরিচালক শফিকুল হক প্রথম আলোকে বলেন, মংলা-ঘাসিয়াখালী খালটি খননের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। ইতিমধ্যে দরপত্র প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। খালটি খনন হলে আবারও এ পথেই যাবে পণ্যবাহী জাহাজ।
সুন্দরবনের ভেতরে ভারত-বাংলাদেশ নৌ-প্রটোকলের পথ সম্পর্কে জানতে চাইলে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক বন্য প্রাণিবিষয়ক গবেষণা সংস্থা স্পিথোনিয়ান কনজারভেশন পার্টনারশিপের প্রকল্প পরিচালক মহেন্দ্র শ্রেষ্ঠা প্রথম আলোকে বলেন, যেকোনো দ্বিপক্ষীয় চুক্তির ক্ষেত্রে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক আইনের বিষয়টি আমলে নিতে হবে। সুন্দরবন একটি রামসার এলাকা এবং ইউনেসকো ঘোষিত বিশ্ব ঐতিহ্য। এ ছাড়া বাংলাদেশ ও ভারত সুন্দরবন এবং বেঙ্গল টাইগার রক্ষায়ও একটি চুক্তি করেছে। ফলে সুন্দরবনের ভেতর দিয়ে নৌপথ চালানোর ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক রীতিনীতিগুলো মেনে বন রক্ষার কথা বিবেচনা করে চলা উচিত।
সুন্দরবনে বাণিজ্যপথ: বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে নৌপথে বাণিজ্য সম্প্রসারণে ১৯৭২ সালে নৌ-প্রটোকল করা হয়। কলকাতা থেকে নৌপথে সুন্দরবনের ভেতর দিয়ে খুলনা হয়ে নারায়ণগঞ্জ ও ঢাকায় পণ্য আনা-নেওয়ার সুযোগ রয়েছে। নৌবাণিজ্যে পণ্যবাহী জাহাজকে সুন্দরবনের ভেতরে প্রায় দেড় শ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিতে হয়।
এখন জাহাজগুলো বাগেরহাটে এমজি খালে না গিয়ে শরণখোলায় দুধমুখী নদী দিয়ে সুন্দরবনে প্রবেশ করে। তারপর সুন্দরবনের হরিণটানা, মরাভোলা, আন্ধারমানিক, জয়মণিঘোল হয়ে পশুর নদে আসে জাহাজ। এরপর পশুর নদ দিয়ে মংলা, চালনা হয়ে চুনকুড়ি নদী দিয়ে নৈলান নামের একটি স্থানে গিয়ে আবার সুন্দরবনে প্রবেশ করে। এরপর পুরোটাই বাংলাদেশ অংশের সুন্দরবন। সুন্দরবনের মধ্য দিয়ে আংটিহারা হয়ে রায়মঙ্গল নৌসীমান্ত দিয়ে ভারতের হেমনগরে প্রবেশ করে পণ্যবাহী জাহাজ। এ সময় সুন্দরবনের মধ্য দিয়ে প্রায় এক শ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিতে হয়। এতে সময় লাগে প্রায় সাড়ে সাত ঘণ্টা। আর আংটিহারা পয়েন্টে শুল্কসংক্রান্ত আনুষঙ্গিকতা শেষ করতে হয়।
তবে এ প্রটোকলের আওতায় বর্তমানে শুধু সিমেন্টশিল্পের জন্য ভারত থেকে ফ্লাই অ্যাশ আমদানি করা হয়। জাহাজমালিকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, প্রতিদিন সুন্দরবনের মধ্য দিয়ে গড়ে ৮-১০টি ফ্লাই অ্যাশবাহী জাহাজ চলাচল করে। প্রায় ৩০ বছর ধরে এমভি নাফ নামের একটি জাহাজে মাস্টারের দায়িত্ব পালন করছেন চট্টগ্রামের সন্দ্বীপের আবুল কাশেম। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘সুন্দরবনের মধ্য দিয়ে যাওয়ার সময় সব সময়ই হরিণ, কুমির, বানর দেখা যায়। জাহাজের শব্দ শুনলে এসব জীবজন্তু হইচই করে ওঠে, পালিয়ে যায়। একবার বাঘও দেখেছি।’
জানতে চাইলে ভারতের বাঘশুমারি প্রকল্পের প্রধান এবং বাংলাদেশ বাঘশুমারি প্রকল্পের উপদেষ্টা জাদভেন্দদেব ঝালা প্রথম আলোকে বলেন, বনের ভেতরের নদী দিয়ে নৌযান চললে তা দুর্ঘটনার পাশাপাশি বন্য প্রাণীর আচরণ ও জিনগত বৈশিষ্ট্যের ওপর প্রভাব ফেলবে। যেমন বাঘসহ বেশ কিছু প্রাণী বনের এক মাথা থেকে অন্য মাথায় বিচরণ করে। যদি বনের ভেতর দিয়ে বড় নৌযান চলে, তাহলে তা বাঘের যাতায়াতে সমস্যা সৃষ্টি করবে।
Post by আশিকুর রহমান চৌধুরী স্বদেশনিউজ২৪.কম