বাংলাদেশের সন্তান আবদুল্লাহ আল মামুন একজন স্বপ্নচারী মানুষ। আর এভাবেই রাজশাহী থেকে রাশিয়া। ’৮৩ সালে রাজশাহী থেকে ৩০ কিলোমিটার দূরে দুর্গাপুর উপজেলার কাশিপুর গ্রাম ছেড়ে পাড়ি জমিয়েছিলেন রাশিয়ায়। সেখানেই বিয়ে করে সংসারী হয়েছেন। তবে দেশের টানে বারবার ফিরে এসেছেন গ্রামে। স্বপ্ন ছিল মেয়ে রিতা দেশের নাম উজ্জ্বল করবে। অলিম্পিকে স্বর্ণ ছিনিয়ে আনবেন মেয়ে মার্গারিটা। কিন্তু দেশের ক্রীড়াসংশ্লিষ্ট মহলের অনাদরে রাশিয়ার হয়ে বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত মার্গারিটা জিমন্যাস্টিকসে স্বর্ণ জিতলেন। যে বিজয় উল্লাসে আমাদের মাতোয়ার হওয়ার কথা সে বিজয় গিয়ে উঠলো রাশিয়ার ঘরে।
রোববার মার্গারিটার পৈতৃক বাড়ি কাশিপুরে গিয়ে দেখা যায়, পাকা সড়কের পাশে জলাশয়। বিপরীতে রয়েছে বিশাল একটি পুকুর। এর মাঝে মেঠোপথ ধরে ২০ কদম এগোলেই পাকা বাড়ি। দেশে এলে এ বাড়িতেই থাকেন মামুন। বাকি সময় তালাবদ্ধ থাকে। পাশেই থাকেন তার বোন দিনা জোহরা। মামুনরা ৪ ভাই ৩ বোন। মামুন ছিলেন সবার ছোট এবং স্বাভাবিকভাবেই সকলের আদরের। রাজশাহী মেডিকেল কলেজের ছাত্র ছিলেন মামুন। কিন্তু চিকিৎসাশাস্ত্র ভালো না লাগায় রাশিয়ায় পাড়ি দেন। সেখানেই মেরিন ইঞ্জিনিয়ারিং শেষে রাশিয়ান এক মেয়েকে বিয়ে করেন। বিয়ের ৬ মাসের মাথায় তারা দেশে এসেছিলেন। সে সময় ইসলাম ধর্মানুসারে তাদের আবারো বিয়ে দেয়া হয়। স্ত্রীর নাম দেন আন্না। এরপর গর্ভাবস্থাতেও আন্না মামুনের সঙ্গে গ্রামে এসেছেন। পরে রিতা যখন ৪/৫ বছরের তখন তারা সপরিবারে গ্রামে আসেন। এ সময় রিতা মা-বাবার হাত ধরে গ্রাম ঘুরে বেড়াতেন। বেশির ভাগ সময় কেটেছে পুকুর পাড়ে। পুকুর ঘাটে মাছ ধরে বেশি সময় কাটতো মামুনের। সে ছোটবেলা থেকে মাছ ধরতে খুব ভালোবাসতো। মামুন মাছ ধরতো আর রিতা তার বাবার কোলে-কাঁধে বসে থাকতো। প্রতিবেশী বলতে পাশে একটি বাড়ি আছে। বাড়ির বাসিন্দা রাঞ্জুরা খাতুন জানান, তার মেয়ে আদুরি যখন খুব ছোট তখন রিতা একবার গ্রামে আসে। ফুটফুটে মেয়ে। সবসময় বাড়ির আশেপাশে ঘুরে বেড়াতো। তার মেয়ে আদুরীর সঙ্গে খেলা করতো। সে সময় বেশিদিন থাকেনি। তবে রিতার মুখ আজও ভাসে।
রিতার (মার্গারিটা) বড় চাচা এসএম খসরু ও বড় ফুফু দিনা জোহরা জানান, রিতাকে শেষ দেখেছেন ২০০৪ সালে মেজোবোনের ঢাকা রূপনগরের বাসায়। সেবার গ্রামের বাড়ি আসা হয় নি। সবাই ঢাকা গিয়েছিলাম। এর আগে অবশ্য রিতা ৩ বার কাশিপুরে এসেছে। অল্পসময়ের মধ্যে সবাইকে আপন করে নেয়। ও ভালো বাংলা বলতে পারতো না। ভাঙ্গা ভাঙ্গা বাংলায় আমাদের সাথে কথা বলতো। তবে বাংলা ঠিকই বুঝতে পারতো।
তারা আরো জানান, মামুন দেশের টান কখনও ভুলতে পারেনি। ঢাকার আরামবাগে একটা ফ্লাট কিনেছিল দেশে মাধে মধ্যে আসবে বলে। ইচ্ছা ছিলো মেয়ে মার্গারিটা অলিম্পিকে স্বর্ণ জিতে দেশের নাম উজ্জ্বল করবে। রিতারও তাই ইচ্ছা ছিল। দেশে এসে বহুবার চেষ্টও করছে। তবে কেউ সাড়া দেয় নি। শুনেছি রাজশাহীর ছেলে পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম মামুনের মস্কোর বাসায় গিয়ে এনিয়ে দুঃখ প্রকাশ করেছেন।
দিনা জোহরা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেন, কিডনির অসুখ হওয়ায় তার ভাইটি আর দেশে আসতে পারে না। আর বোধহয় কখনও আসাও হবে না। বাড়িটি ফাঁকা পড়ে থাকবে। শুধু পিতার ভিটায় তিনি একাই পড়ে রইলেন। পুকুর ঘাটে গেলে মামুনের কথা খুব মনে পড়ে। তার মেয়ে রিতা ও ছেলে ফিলিপের কথা মনে হলে কান্না চলে আসে। রিতার মতো ফিলিপও চটপটে। খুব চমৎকার বাংলা বলে।
এদিকে রিতার অলিম্পিক বিজয়ে পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম ফেসবুক পেজে স্ট্যাটাস দেন, ইউরোপিয়ান চ্যম্পিায়নশিপ জেতার ২ দিন পরে গতবছর এই সময়ে তাদের সম্মানে নৈশভোজের আয়োজন করেছিলাম মস্কোর অদূরে। মামুন ভাই কথা দিয়েছেন অলিম্পিকের পরে মেয়েকে নিয়ে বাংলাদেশে আসবেন। তখন বাংলার বাঘিনীর জন্য ফুলের তোড়াটা নিশ্চয় আরও অনেক বড় হবে।
এর আগে তিনি লেখেন, মার্গারিটা মামুন রিদমিক জিমন্যাস্টিকসে প্রথম হয়ে স্বর্ণ জিতেছে !!! তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় তার পিতা বাংলাদেশ অলিম্পিক অ্যাসোসিয়েশনে যোগাযোগ করেছিল তার মেয়েকে বাংলাদেশের হয়ে অংশগ্রহণ করানোর জন্য, কিন্তু তখনকার প্রশাসন আগ্রহ প্রকাশ করেনি। যাহোক তবুও আমরা তার এই অর্জনে আনন্দিত তো হতেই পারি।