খাবার, বিশুদ্ধ পানি আর জ্বালানি তেলের সংকটে বিপর্যয়ের মুখে রাঙ্গামাটিবাসী। চট্টগ্রামের সঙ্গে রাঙ্গামাটির সড়ক যোগাযোগ তিন দিনেও স্বাভাবিক না হওয়ায় এ পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে। ওদিকে প্রধান সরবরাহ লাইন ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় ৬ লাখ ২০ হাজার জনসংখ্যার এ শহর বিদ্যুৎহীন ছিল তিন দিন। বৃহস্পতিবার রাতে অনেক এলাকায় বিদ্যুৎ আসা শুরু করলেও পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়নি এখনো। বিদ্যুৎ জটিলতায় পানি সরবরাহও বন্ধ। রাঙ্গামাটি জেনারেল হাসপাতালে গত তিন দিন জেনারেটর দিয়ে কাজ চালানোর চেষ্টা হলেও রোগী ও স্বজনরা পড়েছেন ভোগান্তিতে। বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের রাঙ্গামাটির তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী দুলাল হোসেন বলছেন, এ বিপর্যয়ে কী পরিমাণ ক্ষতি হয়েছে তা এখনো নিরূপণ করা সম্ভব হয়নি। এদিকে বৃহস্পতিবার রাত সাড়ে ৮টার পর শহরের কিছু এলাকায় বিদ্যুৎ সরবরাহ শুরু হয়। রাত ১০টার দিকে শহরের ৭০ শতাংশ এলাকায় বিদ্যুৎ ফিরেছে জানিয়ে দুলাল হোসেন বলেন, ধীরে ধীরে সব জায়গাতেই চালু করা যাবে বলে তারা আশা করছেন। ?বিদ্যুৎ সরবরাহ স্বাভাবিক করার পাশাপাশি সড়ক যোগাযোগ সচল করার ওপর জোর দেন তিনি।
অপরদিকে শহরের ভেতরে ১০ টাকার গাড়িভাড়া ৩০ টাকায় উঠেছে। চাল-ডাল-তেল, এমনকি আলু-পটলের ব্যবসায়ীরাও দাম বাড়িয়ে দিয়েছেন। গ্যাস সিলিন্ডারসহ সড়ক পথে যেসব পণ্য বাইরে থেকে আসে, সেগুলোর সংকট দেখা দিয়েছে। এদিকে তেল পাওয়া কঠিন হওয়ায় জেলা সদরের ভেতরেও যান চলাচল কমে গেছে। রাঙ্গামাটি শহরে চলাচল করছে হাতেগোনা কয়েকটি ব্যক্তিগত যানবাহন ও অটোরিকশা। গণপরিবহনের ভাড়া বেড়ে গেছে কয়েকগুণ। জেলা প্রশাসনের নির্বাহী ম্যাজিস্টেটরা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করছেন।
রাঙ্গামাটি অটোরিকশা শ্রমিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক শহিদুজ্জামান মহসিন রোমান বলেন, ‘দুর্যোগ মুহূর্তে আমরা ন্যায্য ভাড়া নিচ্ছি। কোনো চালক বেশি ভাড়া নিলে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে।’
পাহাড়ধসের পর থেকে সড়ক যোগাযোগ বন্ধ থাকায় জেলার বাইরে থেকে তেল বা গ্যাস সিলিন্ডার নিয়ে কোনো গাড়ি আসতে পারেনি। ফলে নতুন বিপদ হয়ে এসেছে জ্বালানি সংকট। চারটি পেট্রোল পাম্প এবং কয়েকজন খুচরা তেল বিক্রেতাই রাঙ্গামাটি সদরে জ্বালানি প্রাপ্তির উৎস। এর মধ্যে বনরূপা ও রাজবাড়ির পাম্প দুটি বন্ধ থাকায় বাকি দুটি পাম্পে প্রচণ্ড ভিড়। বহু মানুষকে প্লাস্টিকের ক্যান হাতে লাইন দিয়ে তেলের অপেক্ষায় থাকতে দেখা গেছে। সব মিলিয়ে কার্যত বিচ্ছিন্ন এ জনপদের মানুষকে দুর্বিষহ পরিস্থিতির মধ্যে দিয়ে যেতে হচ্ছে বলে স্থানীয় বাসিন্দা ও প্রশাসনের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন।
রাঙ্গামাটি জেলায় প্রাণহানির ঘটেছে জেলা সদরের শিমুলতলী, যুব উন্নয়ন এলাকা, মানিকছড়ি, শালবন, নয়াপাড়া, সার্কিট হাউজ, মনতলা, ভেদভেদি, রাঙ্গাপানি, দক্ষিণ মুসলিমপাড়া ও পশ্চিম মুসলিমপাড়া এবং জেলার কাউখালি, কাপ্তাই, জুরাছড়ি ও বিলাইছড়িতে। বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা পর্যন্ত জেলায় ১১০ জনের মরদেহ উদ্ধারের কথা জানিয়েছে জেলা প্রশাসনের নিয়ন্ত্রণ কক্ষ।
রাঙ্গামাটি সদরের ১৩টি আশ্রয়কেন্দ্রে ক্ষতিগ্রস্থ এক হাজার নয়শ মানুষ আশ্রয় নিয়েছে। এর বাইরে জেলায় আরও ২৩টি আশ্রয় কেন্দ্রে দুর্গতদের রাখার ব্যবস্থা হয়েছে।
এদিকে রাঙ্গামাটি ফায়ার সার্ভিসের উপ-সহকারী পরিচালক দিদারুল আলম জানান, সদর উপজেলার শিমুলতলি, ভেদভেদি, দক্ষিণ ও পশ্চিম মুসলিমপাড়া, মানিকছড়ি ও রাঙ্গাপানি এলাকায় বৃহস্পতিবারও তাদের উদ্ধার অভিযান চলে। আশ্রয়কেন্দ্রে আসা মানুষের দেখাশোনার জন্য জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে একটি কমিটিও করে দেওয়া হয়েছে।
এছাড়া ধসে পড়া সড়ক এলাকায় ?উদ্ধারকাজ পরিচালনা করছে সেনাবাহিনী, জেলা প্রশাসন, সড়ক ও জনপথ বিভাগ এবং বিদ্যুৎ বিভাগের বেশ কয়েকটি দল। উপজেলাগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন থাকায় ক্ষয়ক্ষতির বিস্তারিত তথ্য এখনো পায়নি জেলার ত্রাণ ও পুনর্বাসন দপ্তর।
জেলা সদরের বাসিন্দারা জানান, ‘পরিস্থিতি খুবই নাজুক। জানমালের ক্ষতি তো হয়েছেই। আমাদের সবাইকে এখন সীমাহীন দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে।’