পদ্মার ভয়াবহ তাণ্ডবে প্রতিনিয়তই নদীগর্ভে বিলীন হয়ে যাচ্ছে রাজবাড়ী জেলার গোয়ালন্দ উপজেলার দেবগ্রাম ও দৌলতদিয়া ইউনিয়ন।
গেলে ৩-৪ দিনের অব্যাহত নদী ভাঙনে এই ইউনিয়নের হাজার হাজার বিঘা ফসলি জমি ও শত শত পরিবার গৃহহীন হয়ে পড়েছে। এ সকল পরিবারগুলো সরকারি বাঁধে বা রেল সড়কের পাশে আশ্রয় নিয়ে অত্যন্ত মানবেতর জীবন-যাপন করছেন।
রাজবাড়ীর গোয়ালন্দ উপজেলার দৌলতদিয়া ও দেবগ্রাম ইউনিয়নের বিভিন্ন এলাকায় তীব্র নদী ভাঙন দেখা দিয়েছে। এতে অনেকেই পরিবার-পরিজন নিয়ে পূর্ব পুরুষের ভিটেমাটি ছেড়ে নিরাপদ স্থানে চলে যাচ্ছে। এদিকে দৌলতদিয়ার গুরুত্বপূর্ণ ছয় নম্বর ফেরিঘাটটি ভাঙনের মুখোমুখি হয়েছে। অন্য পাঁচ নম্বর ঘাটটিও ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় রয়েছে। তবে সেখানে বালুর বস্তা ফেলে ঘাট রক্ষার চেষ্টা চালাচ্ছেন পানি উন্নয়ন বোর্ডের কর্মীরা।
বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ-পরিবহন সংস্থার (বিআইডাব্লিউটিসি) দৌলতদিয়া ঘাট ব্যবস্থাপক শফিকুল ইসলাম জানান, ফেরিঘাট এলাকায় নদীভাঙন শুরু হওয়ায় ছয় নম্বর ঘাটটি হুমকিতে রয়েছে। তাই এলাকার নদীভাঙন রোধে দ্রুত প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে হবে।
পদ্মার ভয়াবহ ভাঙনে মানচিত্র থেকে হারিয়ে যেতে বসেছে রাজবাড়ীর গোয়ালন্দ উপজেলার দেবগ্রাম ইউনিয়ন। গত তিন-চার দিনের অব্যাহত ভাঙনে এ ইউনিয়নের হাজার হাজার বিঘা ফসলি জমি এখন নদীতে।
জমি ও বসতভিটা হারিয়ে পদ্মাপাড়ের কয়েকশ’ পরিবার এখন নিঃস্ব। রাজবাড়ীর গোয়ালন্দ উপজেলার দেবগ্রাম ও দৌলতদিয়া ইউনিয়নে পদ্মার ভাঙনে ইতিমধ্যেই গৃহহীন হয়ে কয়েক হাজার মানুষ এলাকা ছেড়েছেন।
এখনই ভাঙন রোধে যথাযথ ব্যবস্থা না নিলে গোয়ালন্দের মানচিত্র থেকে দেবগ্রাম ও দৌলতদিয়া নামের দুটি ইউনিয়ন হারিয়ে যাবে। পদ্মা নদীর ভাঙনে শুধুই ছোট হয়ে আসছে রাজবাড়ীর গোয়ালন্দ উপজেলা। গেল ১৫ বছরে এ উপজেলার ৪৯টি গ্রাম পদ্মা নদীতে বিলীন হয়ে গেছে।
উপজেলার একশ’ ১৪টি গ্রাম এখন চারদিকে পদ্মাবেষ্টিত হয়ে আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছে বাকি ৬৫টি গ্রামের বাসিন্দারা। দুমাস ধরে উপজেলার পদ্মা-তীরবর্তী এলাকা ভাঙছে।
দৌলতদিয়ার বেপারীপাড়া, যদুমাতবর পাড়া, দৌলতদিয়ার ছয় নম্বর ঘাট, সিরাজখার পাড়া ও দেবগ্রাম ইউনিয়নের চর বরাট, অন্তার মোড়, দেলুনদী, তেনাপচা ও দেবগ্রামে ভাঙনের তীব্রতা বেশি। গত দুমাসের ভাঙনে এখানকার প্রায় এক হাজার পরিবার গৃহহীন হয়েছে। রাজবাড়ীর গোয়ালন্দে পদ্মার ভাঙনে ক্ষতিগ্রস্ত হাজার হাজার মানুষের একটাই দাবি ‘রিলিফ চাই না, চাই নদী শাসন।’
এদিকে পূর্ব ঘোষণা ছাড়াই আজ শনিবার দুপুরে নদী তীরে মানববন্ধনে অংশ নিয়েছে সহস্রাধিক মানুষ।
কয়েকদিনের ভয়াবহ নদী ভাঙনে গোয়ালন্দ উপজেলার দেবগ্রাম ইউনিয়নের বিস্তীর্ণ এলাকা নদীতে বিলীন হয়ে যায়। নদী ভাঙনের তীব্রতা ও ক্ষতিগ্রস্তদের সঙ্গে কথা বলতে শনিবার সরেজমিন পরিদর্শনে আসেন শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী ও রাজবাড়ী-১ আসনের সংসদ সদস্য কাজী কেরামত আলী, জেলা প্রশাসক মো. শওকত আলী, পুলিশ সুপার আসমা সিদ্দিকা মিলিসহ প্রশাসনের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা। এদিকে প্রতিমন্ত্রী ও প্রশাসনের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের নদীভাঙন পরিদর্শনে আসার খবর শুনে নদী তীরের বিভিন্ন পয়েন্টে জড়ো হন ক্ষতিগ্রস্ত হাজার হাজার মানুষ। তাদের মুখে একটাই স্লোগান উচ্চারিত হয়, ‘রিলিফ চাই না, চাই নদীশাসন।’
এদিকে রাজবাড়ীর কালুখালীর রতনদিয়া ইউনিয়নের সাদারচর, হরিণবাড়ীয়া, প্রস্তাবিত রাজবাড়ী সেনানিবাস ও জেলা শহরের গোদারবাজার ঘাট এলাকা পদ্মার ভাঙনের তীব্র হুমকিতে রয়েছে। গেল মঙ্গলবার রাতে রাজবাড়ী শহর রক্ষা বাঁধের নদীর পার সংরক্ষণ গোদারবাজার ঘাটের অবকাশকেন্দ্র ‘বন্ধন’-সংলগ্ন ২০০ মিটার নদী তীর রক্ষা বাঁধ ধসে গেছে।
বর্তমানে সেখানে পানি উন্নয়ন বোর্ডের পক্ষ থেকে বালুভর্তি জিও ব্যাগ ফেলে ভাঙন রোধের চেষ্টা চলছে। তাছাড়া কালুখালীর রতনদিয়া এলাকার বেশ কয়েকটি গ্রাম নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। রাজবাড়ী সেনা ক্যাম্প নামক পিলার থেকে সোয়া কিলোমিটার এসবিবি ইটের রাস্তার কিছু অংশ ও সাদার বাজার সম্পূর্ণ ধসে গেছে। এছাড়া লস্করদিয়া নারায়ণপুর গ্রামের কয়েকশ’ বাড়িঘর পদ্মায় বিলীন হয়ে গেছে।
শনিবার দুপুরে দেবগ্রাম মধু সরদার পাড়া গ্রামে সরেজমিন গিয়ে দেখা যায়, দুই এক মিনিট পর পরই নদীর পাড়ের বিশাল অংশ ভেঙে পড়ছে নদীতে। ভয়াবহ এই পরিস্থিতি দেখতে নদীর পাড় জুড়ে ভিড় করেছে শত শত মানুষ। এসময় কথা হয় ১০ নম্বর যদু মাতুব্বার পাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক আকাশ মৃধা ও মকবুল হোসেনের। তারা জানান, তারা ২০-২৫ মিনিট আগে এখানে এসেছেন ভাঙন দেখতে। এই অল্প সময়ের মধ্যেই তাদের চোখের সামনে অন্তত একশ’ ফুট জায়গা নদীগর্ভে চলে গেলো।
গোয়ালন্দ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আবু নাসার উদ্দিন বলেন, পদ্মার ভয়াবহ ভাঙন সম্পর্কে ইতিমধ্যে প্রশাসন অবগত হয়েছে। গতকাল শনিবার শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী কাজী কেরামত আলী ও জেলা প্রশাসক ভাঙনকবলিত এলাকা পরিদর্শন করেছেন। এসময় তারা ভাঙন প্রতিরোধে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণ ও ক্ষতিগ্রস্তদের সহযোগিতায় সম্ভব সব ধরনের ব্যবস্থা নেওয়ার কথা জানিয়েছেন।
অপরদিকে ওইসব এলাকার মানুষ পরিবার পরিজন নিয়ে বসত ভিটে থেকে দ্রুত ঘড়-বাড়ি ভেঙে অন্যত্র সরিয়ে নেয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। বসতভিটা থেকে চির বিদায়ের প্রস্তুতি নিচ্ছেন ফরিদা বেগম (৪৫) নামের এক গৃহিনী। তিনি চোখের পানি মুছতে মুছতে বলেন, ‘ঘর ভাইঙা নিয়া এক আত্মীয়র বাড়ি রাখতাছি। সেহানে রাইখা দমডা ফালাই, হেরপর দেহুম কোনে যাওয়ন যায়। এহানেতো ভাঙনের ডরে দম বন্দ হয়া আসতাছে।’
আর একটু এগুতেই চোখে পড়ল এক হৃদয়বিদারক দৃশ্য। একটি পরিবার তাদের ঘর-বাড়ি, গরু-ছাগল নিয়ে একটি ট্রলার বোঝাই করে অন্যত্র চলে যাচ্ছে। নারী-পুরুষ-শিশুসহ প্রত্যেকেরই চোখে জল। তাদের বিদায় দিতে আসা গ্রামবাসীর চোখেও জল।
এ বিদায় যেন অন্য রকম এক যন্ত্রনার। বছরের পর বছর যাদের সঙ্গে কেটেছে, কত স্মৃতি জড়িয়ে আছে, সব ছিন্ন করে অজানার উদ্দেশে যাত্রা। হয়তো আর কখনো এভাবে দেখা হবে না। বিদায় নেয়া পরিবারের সদস্য লালন সরদার (৪৮) কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, ‘পাগলা নদী আমাগো একসঙ্গে থাকতে দিলো না।’
দেবগ্রামের তোরাপ আলী সরদার (৬০), ফুলচাদ (৪৫), রিজিয়া বেগম (৩৮), আবুল শেখ (৫০), আফছার সরদারসহ (৬৫) অনেকেই জানান, সপ্তাহখানেক ধরে এ এলাকার নদী ভাঙন ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। প্রতি মুহূর্তে এ এলাকার মানুষ নিঃস্ব হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু দুঃখের বিষয় কোনও জনপ্রতিনিধি বা সরকারের কেউ তাদের খবর নিতে আসেননি। তাদের সামন্যতম খোঁজ-খবর পর্যন্ত নেননি।
এদিকে পদ্মা নদীর ভাঙনে বিস্তীর্ণ এলাকার ফসলসহ জমি নদীগর্ভে বিলীন হওয়ায় ওই এলাকার কৃষকরা দিশেহারা হয়ে পড়েছেন। চর দেলুনদী গ্রামের কৃষক আ. ছালাম (৬০) জানান, নদী ভাঙনে তার আট বিঘা ফসলি জমি নদীগর্ভে চলে গেছে। এসময় তার পাশে থাকা নুর ইসলাম, সোহাগী বেগম, নুরজাহান বিবিসহ অনেকে বলেন, গত কয়েক দিনে চর বরাট, অন্তার মোড়, দেলুনদী, তেনাপচা, দেবগ্রামসহ নদী পাড়ের জমিতে থাকা বিভিন্ন ধরনের ফসল নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। তারা আরও জানান, তারা প্রত্যেকেই ৩-৪ বার করে নদী ভাঙনের শিকার হয়ে নিঃস্ব হয়ে গেছেন।
দেবগ্রাম ইউনিয়নটিকে ভাঙনের হাত থেকে রক্ষার দাবিতে গত মঙ্গলবার শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী ও রাজবাড়ী-১ আসনের সংসদ সদস্য কাজী কেরামত আলী ও জেলা প্রশাসকের কাছে ইউপি চেয়ারম্যান আতর আলী সরদারের নেতৃত্বে স্মারকলিপি দিয়েছেন ইউনিয়নবাসী।
দেবগ্রাম ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান আতর আলী সরদার জানান, তার ইউনিয়নের ৩, ৪ ও ৫ নম্বর ওয়ার্ডের শতশত পরিবার ভাঙন আতঙ্কে ভিটেমাটি ছাড়ছেন। এই কয়েক দিনে প্রায় দুই কিলোমিটার এলাকার বসতবাড়ি ও ফসলি জমি নদীতে বিলীন হয়ে গেছে। কয়েক বছর ধরে অব্যাহতভাবে ইউনিয়নটি নদী ভাঙনের শিকার হলেও এখন পর্যন্ত ভাঙন রোধে কোনও ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি কর্তৃপক্ষ। এ ইউনিয়নে অর্ধেকের বেশি অংশ নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। বাকিটুকুও যাবার উপক্রম হয়েছে এখন। শত শত পরিবারের ঘর-বাড়ি ভাঙছে, তারা কোথায় যাবে। এখনই ভাঙন রোধে যথাযথ ব্যবস্থা না নিলে গোয়ালন্দের মানচিত্র থেকে দেবগ্রাম ও দৌলতদিয়া নামের দুটি ইউনিয়ন হারিয়ে যাবে।
রাজবাড়ী পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী প্রকাশ সরকার বলেন, বর্তমানে রাজবাড়ী জেলার পদ্মা পাড়ের বেড়ীবাঁধের বাইরের বিভিন্ন এলাকায় আটশ’ ৭৫ মিটার জুড়ে ভাঙন রয়েছে।’