ব্যবসা-বাণিজ্যের পরিস্থিতি ও বাজেটে প্রত্যাশা নিয়ে কথা বলেছেন ইন্টারন্যাশনাল চেম্বার অব কমার্স বাংলাদেশের (আইসিসিবি) সভাপতি মাহবুবুর রহমান
Journalist: ব্যবসায়ীরা এখন বলছেন, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ছাড়া বিনিয়োগ বাড়বে না। তা হলে কী এখনো রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ফিরে আসেনি?
মাহবুবুর রহমান: আমি একটু অন্যভাবে এ প্রশ্নের জবাব দিতে চাই। ভারতের নতুন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী থেকে আহমেদাবাদকে তথ্যপ্রযুক্তিসেবার অন্যতম প্রাণকেন্দ্র হিসেবে গড়ে তোলার ঘোষণা দিয়েছিলেন। তিনি বেঙ্গালুরুর সঙ্গে পাল্লা দিতে চেয়েছেন। সে জন্য নীতি-পদক্ষেপ গ্রহণ করেছেন। আর তাই আহমেদবাদ এখন তথ্যপ্রযুক্তি আউটসোর্সিং সেবায় বিশ্বে ৬৩তম স্থানে উঠে এসেছে। যদিও বেঙ্গালুরুর আগের প্রথম অবস্থানেই রয়ে গেছে। এখানে মূল বিষয়টি হলো রাজনৈতিক সদিচ্ছা ও দৃঢ়তা। আমাদেরও একই ধরনের রাজনৈতিক সদিচ্ছা ও দৃঢ়তা প্রয়োজন। আর তা নির্ভর করে স্থিতিশীল রাজনৈতিক পরিবেশের ওপর। আপাত দৃষ্টিতে একটি স্থিতিশীলতা আসছে বলে মনে হচ্ছে। তবে একধরনের অনিশ্চয়তাবোধও একই সঙ্গে কাজ করছে। তাই সরকারকে এই অনিশ্চয়তা কাটানোর বার্তা দিতে হবে কাজের মধ্য দিয়ে। এই যেমন প্রধানমন্ত্রী জাপান সফরে গিয়ে দেশটি থেকে প্রায় ৬০০ কোটি ডলার সাহায্যের প্রতিশ্রুতি এনেছেন। এটা একটা বড় ইতিবাচক দিক।
Journalist: অর্থমন্ত্রী ২০১৪-১৫ অর্থবছরের বাজেটের মধ্য দিয়ে আগামী পাঁচ বছরের অর্থনৈতিক কর্মপরিকল্পনার রূপরেখা দেবেন। আপনি বিষয়টি কীভাবে দেখছেন?
মাহবুবুর রহমান: বাজেট মূলত এক বছরের পরিকল্পনা। এর মধ্যে মধ্যমেয়াদি বা পাঁচ বছরের রূপরেখা থাকতে পারে। কিন্তু অর্থমন্ত্রী কীভাবে এটি করবেন, তা আমরা জানি না। সুতরাং, বাজেট ঘোষণা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। তা ছাড়া সরকারের তো পাঁচসালা পরিকল্পনা ও ১০ বছরের প্রেক্ষিত পরিকল্পনা রয়েছে। পরিকল্পনার এই চর্চা মূলত সমাজতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে এসেছে। এখন আমাদের পর্যালোচনা করা উচিত যে এই পরিকল্পনা থেকে আমরা কতটুকু উপকৃত হয়েছি বা হচ্ছি।
প্রথম আলো: এবারের বাজেটে কোন বিষয়গুলোকে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেওয়া উচিত?
মাহবুবুর রহমান: বাজেট নিয়ে আমাদের ব্যবসায়ী সংগঠনগুলো অনেক সুপারিশ ও পরামর্শ দিয়েছে। আমি তার অনেকগুলোর সঙ্গেই একমত। তবে আমার নিজের একটি প্রস্তাব নিয়ে আগে আমি বিভিন্ন সময়ে বলেছি। সেটা এখন আবার বলছি। আমি মনে করি, দেশের সব বাণিজ্যিক কর্মকাণ্ডের মালিককে কমপক্ষে পাঁচ হাজার টাকা করে আয়কর দিতে হবে। এ ক্ষেত্রে মূল নজরটা দিতে হবে দোকানপাটসহ ছোট শিল্প-ব্যবসায়, যেগুলোর মালিকেরা আয়কর দেন না। যেহেতু খুব ছোট ব্যবসা ও অল্প লেনদেন সেহেতু তাঁরা বছরে একবার এই অর্থ প্রদান করবেন আর সেটা তাঁরা বাংলাদেশ ব্যাংকে ‘আয়কর হেডে’ সরাসরি জমা দেবেন। আয়কর বিবরণী দাখিল ও পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার প্রয়োজন হবে না। এভাবে বিপুলসংখ্যক ব্যবসায়ীকে আয়করের আওতায় নিয়ে আসা যাবে। এরপর পর্যায়ক্রমে ব্যবসা বড় হলে, আয়-উপার্জন বাড়লে আয়করও বাড়বে। একইভাবে সব পেশাজীবীকেও এভাবে আয়করের আওতায় আনা যেতে পারে। এই প্রস্তাব শুনতে কিছুটা হাস্যকর মনে হতে পারে। কিন্তু ১৬ কোটি মানুষের দেশে ১৬ লাখ মানুষও নিয়মিত আয়কর দেয় না, এটাও তো হতে পারে না।
Journalist: তা হলে আপনি প্রত্যক্ষ করের প্রতি জোর দিচ্ছেন?
মাহবুবুর রহমান: অনেকটাই তাই। আরেকটি বিষয় বলতে চাই। আমদানিতে ৩ শতাংশ হারে অগ্রিম আয়কর দিতে হয়। আমি মনে করি, এটা থাকার দরকার নেই। এতে ঝামেলা বাড়ে। বছর শেষে আয়কর বিবরণী দাখিলের সময় সমন্বয় করতে গিয়ে জটিলতা দেখা দেয়। এটা এমন একটা পদ্ধতি যে আয় হওয়ার পূর্বেই আয়কর দিতে হবে । আসলে আমদািনর পরে অনেক আমদািনকারক আয়করের আওতাবহির্ভূত থাকার কারণে এই অভিনব আয়কর পদ্ধতি!
Journalist: সম্পদের ওপর সারচার্জ আরোপ করা হয়েছে দুই বছর আগেই। এবার এই সারচার্জের হার ও পরিধি বাড়ছে বলে জানা গেছে। এটা কতটা অর্থবহ হবে?
মাহবুবুর রহমান: সমাজে আয়বৈষম্য বেড়ে গেছে বলে সম্পদের ওপর সারচার্জ আরোপ করা হয়েছে। আসলে এটাও একধরনের কর। এর মধ্য দিয়ে বৈষম্য কতটা কমানো যাবে তা আমি জানি না। তবে এটা যথেষ্ট যুক্তিযুক্ত মনে হয় না। কেননা, কোনো ব্যক্তি তার কর পরিশোধিত এ অর্জিত আয় দিয়েই সম্পদ গড়ে তোলে । আর অর্জিত আয়ের ওপর প্রযোজ্য হারে কর দিতে হয়। যারা ঠিকমতো কর না দিয়ে বা ফাঁকি দিয়ে সম্পদ গড়েছে, তাদের অবশ্যই আয়করের আওতায় আনতে হবে । কিন্তু যারা ঠিকমতো কর দিয়ে সম্পদ সৃষ্টির মাধ্যমে অর্থনীতিতে অবদান রাখছে, তারা কেন বারবার এ ধরনের সারচার্জ দেবে? তা ছাড়া যতক্ষণ পর্যন্ত বাড়ি বা জমির মতো স্থাবর সম্পদ-সম্পত্তি বিক্রি করে নগদ অর্থে রূপান্তর করা না হচ্ছে, ততক্ষণ পর্যন্ত সম্পদের লাভালাভ তো পাওয়া যাচ্ছে না। বাড়ির দামের সমপরিমাণ অর্থ ব্যাংকে রাখলে তো সেটার ওপর কোনো কর নেই। কর হবে শুধু প্রাপ্ত সুদ বা মুনাফার ওপর। কাজেই বিষয়টি বিবেচনা করা উচিত।
Journalist: এবারের বাজেটেও সরকারি-বেসরকারি অংশীদারত্বের (পিপিপি) জন্য আবারও বরাদ্দ রাখা হতে পারে। কিন্তু গত চার বছরে এটি তেমন একটা কার্যকর হয়নি। কেন?
মাহবুবুর রহমান: এখনো বেসরকারি উদ্যোক্তারা সরকারি প্রকল্পের সঙ্গে অংশীদারত্বের ভিত্তিতে কাজ করার ক্ষেত্রে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে না। সরকারি কর্মকাণ্ডে আমলাতান্ত্রিক জটিলতা ও দীর্ঘসূত্রতাও একটা সমস্যা। আমার ধারণা, পিপিপিতে সাফল্য পেতে আরও সময় লাগবে৷ নিয়মনীতি বেসরকাির খাতের ধাঁচে ঢেলে সাজাতে হবে। পিপিপি কার্যকর হলে তিন-চার বছরের মাথায় জিডিপি ১ শতাংশ করে বাড়ানো অনেক সহজসাধ্য হবে বলে আমি মনে করি ।