খোলা জায়গায় ময়লা আবর্জনা। বাতাসে ধুলা-বালি উড়ছে। এর মধ্যেই বাঁশে সারি সারি সাজিয়ে রোদে শুকানো হচ্ছে কারখানায় তৈরি কাঁচা সেমাই। সেই সেমাই আবার ছোট কক্ষ আর নোংরা পরিবেশে নামীদামী ব্র্যান্ডের প্যাকেটে ভরে বাজারজাত করছে একটি অসাধু ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট। শুধু তাই নয়, পোড়া মবিলে ভাজা হচ্ছে ব্র্যান্ডের নামে লাচ্ছা সেমাই। ঈদকে সামনে রেখে রাজধানী ও এর আশপাশ এলাকায় গড়ে উঠেছে নকল সেমাই কারখানা। নিয়ম-নীতির তোয়াক্কা না করে অস্বাস্থ্যকর নিম্ন মানের সেমাই নামীদামি ব্র্যান্ডের প্যাকেটে ভরে বিক্রি করা হচ্ছে এসব ভেজাল সেমাই।
রমজানে ভেজাল সেমাই রোধে রাজধানীতে অভিযানে নেমেছে পুলিশ ও র্যাব। তবুও অধিকাংশ ভেজাল কারখানাই রয়েছে ধরাছোঁয়ার বাইরে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, রাজধানী ও আশপাশের এলাকায় অন্তত তিন’শ কারখানায় সেমাই তৈরি করা হচ্ছে। যার বেশিরভাগই গড়ে উঠেছে অবৈধভাবে এবং ঈদকে ঘিরে। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠিত কোম্পানির নামে প্যাকেটে লেবেল লাগিয়ে তা বাজারে বিক্রির জন্য প্রস্তুত করা হচ্ছে। এক সময় পুরান ঢাকার লালবাগ, হাজারীবাগ, কেরানিগঞ্জ ও কামরাঙ্গির চর এলাকায় সেমাই কারখানা গড়ে উঠলেও এখন তা ছড়িয়ে পড়েছে কদমতলী, শ্যামপুর, যাত্রাবাড়ি, ডেমরা, মিরপুরসহ রাজধানীর আনাচে কানাচে। লালবাগ এলাকায়ই রয়েছে শতাধিক কারখানা। কিন্তু এসব কারখানার বেশিরভাগই বিএসটিআই’র অনুমোদন নেই। এমন কি এসব কারখানার মালিকেরা বিএসটিআই’র ধারে-কাছে যাবারও প্রয়োজন মনে করেন না। ঈদ উপলক্ষে বিএসটিআই’র অসাধু কর্মকর্তারা এসব কারখানা থেকে বাড়তি আয় করছে বলেও অভিযোগ উঠেছে।
জানা গেছে, গত বৃহস্পতিবার কামরাঙ্গিরচরে নোংরা, অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে নিম্নমানের সেমাই প্রস্তুতকারী তিনটি কারখানা সিলগালা ও মালামাল জব্দ করেছে পুলিশ। সিলগালা করে দেওয়া প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে রয়েছে কামরাঙ্গীরচর হুজুর পাড়ায় আব্দুর রহমানের মালিকানাধীন নাসির ফুড প্রডাক্টস, কলেজ রোডে একই মালিকের ফুড প্যাকেট ফ্যাক্টরি, মোহাম্মদ আলীর মালিকানাধীন মিতালী সেমাই ফ্যাক্টরি ও আলী নগরে নাসির হোসেনের হাবিবা ফুড প্রডাক্টস।
এছাড়া শনিবার পুরান ঢাকায় দামি ব্র্যান্ডের তিনটি নকল সেমাই কারখানায় অভিযান চালিয়েছে র্যাবের ভ্রাম্যমাণ আদালত। ভেজাল পণ্য তৈরির অভিযোগে দুই জনকে জেল জরিমানা করা হয়েছে।
তারা হলেন-কাজী সুমন (২৪) ও মোহাম্মদ হোসেন (৩২)। র্যাবের নিবার্হী ম্যাজিস্ট্রেট এএইচএম আনোয়ার পাশার নেতৃত্বে অভিযানে জেল-জরিমানাসহ ভেজাল পণ্য তৈরির ওইসব কারখানা সিলগালা করে দেয়া হয়।
নির্বার্হী ম্যাজিস্ট্রেট আনোয়ার পাশা জানান, শনিবার সকাল ১০টার দিকে পুরান ঢাকার ৬/১৫ চম্পাটুলীলেনের বাসার দ্বিতীয় তলায় অভিযান চালায় র্যাব। সেখান থেকে কুলসুন ও আলাউদ্দিনসহ বিভিন্ন ব্র্যান্ডের নকল সেমাই জব্দ করা হয়। ঘটনাস্থল থেকে গ্রেপ্তার করা হয় কারখানার মালিক কাজী সুমনকে।
কাজী সুমন র্যাবের জিজ্ঞাসাবাদে জানিয়েছেন, তিনি ৩৫ টাকা কেজিতে বিভিন্ন নিম্নমানের সেমাই কিনে আনেন। এরপর দেশি-বিদেশি বিভিন্ন ব্র্যান্ডে সেমাইয়ের প্যাকেটে ভরে বাজারজাত করেন। প্যাকেটের গায়ে ২০০ গ্রাম লেখা থাকলেও সেমাই দেয়া হয় ১৫০ গ্রামের কম। ভ্রাম্যমাণ আদালতের কাছে দোষ স্বীকার করায় তাকে এক বছরের কারাদণ্ড ও এক লাখ টাকা জরিমানা করা হয়েছে। গত বছরও তাকে একই অপরাধে দণ্ড দেয়া হয়েছিলো। চম্পাটলি লেনের অপর একটি কারখানায় অভিযান চালিয়ে ১০০ মণ নকল সেমাই উদ্ধার করা হয়। নকল সেমাই তৈরির অভিযোগে কারখানার ম্যানাজার আব্দুল হাইকে ৫০ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়েছে।
লালবাগ, কামরাঙ্গিরচর, শ্যামপুর, যাত্রাবাড়ি এলাকায় সরজমিনে গিয়ে দেখা গেছে বেশিরভাগ কারখানায়ই অস্বাস্থ্যকর এবং অপরিচ্ছন্ন পরিবেশে সেমাই তৈরী হচ্ছে। অত্যন্ত নিম্নমানের ময়দা, খাবার ছোডা, ভেজাল সয়াবিন তেল, ডালডা ইত্যাদি উপকরণ দিয়ে তৈরী হচ্ছে সেমাই। যা মানুষের স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। পোড়া মবিল দিয়ে ভাজা হচ্ছে লাচ্ছা সেমাই। আবার পঁচা ও নিম্নমানের ময়দা দিয়ে তৈরি হচ্ছে শুকনো সেমাই। শুকানো হচ্ছে নদীর পাড়, বেড়িবাধ কিংবা ধুলা-বালির মধ্যে। এসব কারখানায় কোনো নিয়ম নীতি মানা হচ্ছে না। সেমাই তৈরী করে তা নোংরা পরিবেশে রোদে শুকিয়ে প্যাকেটজাত করা হয়। পাশাপাশি এসব ভেজাল বা অস্বাস্থ্যকর সেমাই প্রতিষ্ঠিত কোম্পানির নামে প্যাকেটজাত করে বাজারে ছাড়া হচ্ছে।
এদিকে যেখানে সেখানে গড়ে ওঠা এসব ভেজাল সেমাই তৈরির কারখানার কারণে ঢাকা পড়ে যাচ্ছে রাজধানীর আসল বা নামকরা সেমাই তৈরীর কারখানাগুলো।
লালবাগে সেমাই কারখানার এক মালিক জানান, ঈদ মৌসুমে রাজধানীতে সেমাই তৈরীর কারখানাগুলো বেশি সচল হয়। যেখানে সেখানে গজিয়ে ওঠে সেমাই কারখানা। ফলে ভেজাল বা নকলের মাঝে হারিয়ে যায় আসল কারখানাগুলো। কারখানা মালিক জানান, সাধারণত সেমাই বা যে কোনো খাদ্যদ্রব্য তৈরীর কারখানার জন্য বিএসটিআই’র অনুমোদন নেয়ার নিয়ম রয়েছে। পাশাপাশি খাদ্যদ্রব্য তৈরির মান নিয়ন্ত্রণের জন্য কারখানায় একজন বিশেষজ্ঞ রাখার নিয়ম রয়েছে। কিন্তু এসব কারখানায় কোনো নিয়ম নীতি তোয়াক্কা করা হচ্ছে না।